• ঢাকা শনিবার
    ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

থামলো যখন ঢেঁকি

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৯, ২০২২, ০১:৩৩ এএম

থামলো যখন ঢেঁকি

গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি

ফিচার ডেস্ক

“ও বউ ধান ভানে রে/ঢেঁকিতে পাড় দিয়া/ঢেঁকি নাচে বউ নাচে/হেলিয়া দুলিয়া/ও বউ ধান ভানে রে...।”

গ্রামবাংলার নববধূ, তরুণী ও কৃষাণীর কণ্ঠে এ রকম গান এখন আর শোনা যায় না। গানটি একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। অনেকের কাছে এখনও প্রিয়। প্রচলিত প্রবাদ আছে- ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।’ ঢেঁকিকে নিয়ে অনেক গান ও প্রবাদ যেমন প্রচলিত আছে, আবার তেমনি তৎকালীন কবি-সাহিত্যিকেরাও তাদের লেখনীতে তুলে ধরেছেন প্রাচীন ঐতিহ্যের বহু কথা।

Husking Pedal is used in various works in village - Anandabazar

কালের বিবর্তনে ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে জীবন সহজ হয়েছে বটে, কিন্তু হারিয়েছে অনেক ঐতিহ্য। অনেক কিছুর মতো বিলুপ্তির পথে আজ গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি। এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না কোথাও।

ঢেঁকি হচ্ছে কাঠের তৈরি কলবিশেষ। প্রায় ৬ ফুট লম্বা ও ২০ ইঞ্চি ব্যাসবিশিষ্ট একটি ধড় থাকে ঢেঁকিতে। মেঝে থেকে ১৮ ইঞ্চি উচ্চতায় ধড়ের সামনে এক ফুট বাকি রেখে দুই ফুট লম্বা একটি গোল কাঠের মাথায় লোহার রিং পরানো থাকে। এটাকে মৌনা বলা হয়। পেছনে দুটি বড় কাঠের দণ্ডের ভেতর দিয়ে একটি হুড়কা হিসেবে কাঠের গোলাকার খিল থাকে।

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি

ঢেঁকি দিয়ে ধান ভানার কাজ হতো। গ্রামীণ জনপদে ধান ভানা ও চালের গুঁড়া বা আটা তৈরির কাজ হতো এই মাধ্যমে। অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে ঘরে আসে নতুন ধান। শুরু হয় তখন নতুন চাল ও চালের গুঁড়া তৈরির কাজ। সেই চালের গুঁড়া থেকে পিঠা-পুলি, ফিরনি-পায়েস তৈরি করা হতো। চালের রুটি-মাংসের ঝোল এই সময়টাতে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি করত। আর এসবের আয়োজন হতো ঢেঁকিতে।

বিলুপ্ত প্রায় ঢেঁকি শিল্প - HelloToday24

এ ছাড়াও নবান্ন উৎসব, বিয়ে, ঈদ ও পূজায় ঢেঁকিতে ধান ভেনে আটা তৈরি করা হতো। বধূরা ঢেঁকিতে কাজ করতেন রাত থেকে ভোর পর্যন্ত। ঢেঁকিতে ছাঁটাই করা চালের ভাত খেতে খুব সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যসম্মত। একসময় মানুষ ঢেঁকিতে ধান ও চাল ভেনে চিঁড়া-আটা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেছে। ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দে মুখরিত ছিল বাংলার জনপদ। কিন্তু এখন ঢেঁকির সেই শব্দ শোনা যায় না। শহরে তো বটেই, আজকাল অনেক গ্রামের ছেলেমেয়েরাও ঢেঁকি শব্দটি শুনেছে, কিন্তু ঢেঁকি দেখেনি। কান চেনে না ঢেঁকির শব্দ। কাকডাকা ভোরে ঢেঁকির ছন্দময় শব্দে ঘুম ভাঙত বাড়ির মানুষের। আজ সেই ছন্দময় জীবন নেই গ্রামের। যান্ত্রিক শব্দ আর যন্ত্রে শত বছরের কীর্তনমুখী জীবন বিবর্ণ হয়ে গেছে।

হাজার বছরের ঐতিহ্য ছিল ঢেঁকি। গ্রামাঞ্চলে প্রায় বাড়িতেই একটি করে ঢেঁকিঘর ছিল। গৃহস্থবাড়ির নারীরা ঢেঁকির মাধ্যমে চাল তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় কাটাতেন। তখন কদরও ছিল এর। গরিব নারীরা ঢেঁকিতে শ্রম দিয়ে আয়রোজগারের পথ বেছে নিতেন। ঢেঁকিতে কাজ করাই ছিল দরিদ্র নারীদের আয়ের প্রধান উৎস। ধানকলের ব্যাপকতায় এই ঢেঁকি বিলুপ্ত হওয়ায় পথে। গ্রামের বাড়িগুলোতে এখন ঢেঁকি কালেভাদ্রে চোখে পড়ে।

 

হারিয়ে যেতে বসেছে ঢেঁকি শিল্প

ঢেঁকি সম্পর্কে জানতে চাইলে বয়োজেষ্ঠ অনেকেই জানান, আগে প্রায় সবার বাড়িতে ঢেঁকি ছিল। সেই ঢেঁকিছাঁটা চাল ও চালের পিঠার গন্ধ এখন আর নেই। আধুনিক যুগে সেই ঢেঁকির জায়গা দখল করে নিয়েছে বিদ্যুৎচালিত মেশিন। আর ভবিষ্যতে প্রাচীন এই যন্ত্রগুলোর দেখা মিলবে কেবল জাদুঘরে।

ঢেঁকির শব্দে উৎসব ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামময় একদিন। সাত গ্রামের মানুষ ভাবত ওই বাড়িতে জামাই উৎসব। ওই বাড়িতে শোল মাছের জমাট বাঁধা ঝোল। ডালের বড়ি দিয়ে সাত ফোঁড়নের তরকারি এখন রূপকথার ঝুলি। যেখানে দাদা-দাদির জীবন ছিল রোদেলা, সেই হারিয়ে যাওয়া ঢেঁকির সঙ্গে ছিল তাদের জীবনগীতি। ছিল বাপ-দাদাদের আদি পরিচয়। ঢেঁকি একদিন স্মৃতি হয়ে যাবে-যাচ্ছে। গ্রাম যেমন শহর হয়ে গেছে, তেমনি ঢেঁকি থাকবে যান্ত্রিক মোড়কে বাঁধা। ঢেঁকি ছিল একদিন, এখন নেই।

 

সাজেদ/

 

আর্কাইভ