প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৭, ২০২২, ০৩:৪১ এএম
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। হিমালয় থেকে নেমে আসা অসংখ্য নদ-নদীর প্রবাহ থেকে এই ভূখন্ডের সৃষ্টি। পৃথিবীর বৃহত্তম এই ব-দ্বীপ গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বছর ধরে বহমান সেই নদীর পলিমাটি থেকে। এসব নদীকেই কেন্দ্র করে মানুষ তার জীবন-জীবিকার পথ তৈরি করে নিয়েছে; তৈরি হয়েছে গান, কবিতা, উপন্যাস ও চলচিত্র।
কবি সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার কয়েকটি পংক্তি এমন ‘আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি, চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে। তেরশত নদী সুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?’ কবির কবিতায় উলেখিত তেরোশত না হলেও অসংখ্য নদী ছিল আমাদের, যা আজ অস্তিত্বহীন।
জনজীবনে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে দেশের অর্থনীতিতে এর ভ‚মিকা গুরুত্বপূর্ণ। নদীর বয়ে আসা পলিমাটিতেই বাংলাদেশের কৃষিজমি অত্যন্ত উর্বর। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে নদীই ভরসা। সেচ আর বিদ্যুতের জন্যও নদীর প্রয়োজন ব্যাপক।
তবে বাংলাদেশ এখন নদী বিপর্যয়ের দেশ। আড়াই শতাধিক নদ-নদী মরে যাওয়ার কথা জানা যায়। অনেক নদী আবার বেদখলও হয়ে গেছে। নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে। নাব্যতা, গভীরতা, আকার আকৃতি হারিয়েছে দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ নদী। এ অবস্থায় নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদ-নদীর ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরি হয়েছে গভীর শঙ্কা।
একদিকে সীমান্তের ওপারে বাঁধ তৈরি করে উজানে এক তরফা পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের নদীগুলোতে জলসঙ্কটের দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে, দেশের মধ্যেই অতিরিক্ত পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদ-নদী। যার কারণে অনেক নদী এখন দেশের মানচিত্র থেকে ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে, নয়তো কোনো রকমে ধুঁকছে।
বাংলাদেশে প্রকৃত নদীর সংখ্যা জানা যায় না। নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, এমনকি নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট কারও কাছে সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ২০১৩ সালে গঠন করা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছেও নেই। বিভিন্ন সূত্রে নদীর যে সংখ্যা জানা যায়, সেই সংখ্যায় বিস্ময়কর রকমের পার্থক্য রয়েছে। ২৩০ থেকে দুই হাজার পর্যন্ত সংখ্যা পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবি) ২০০৫ সালে ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিল। এতে ৩১০টি নদ-নদীর কথা বলা হয়েছিল। এরপর ২০১১ সালে আরও অনুসন্ধান শেষে গ্রন্থটি ছয় খণ্ডে প্রকাশ করে পাউবি। সেখানে নদ-নদীর সংখ্যা বলা হয় ৪০৫টি। অনেকেই এই সংখ্যাকে নদীর সংখ্যা হিসেবে গণনা করছেন।
পাউবিকর্তৃক নির্ধারিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী ১০২টি, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১১৫টি, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৮৭টি, উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ৬১টি, পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের ১৬টি এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ২৪টি হিসেবে বিভাজন করে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৮০০ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪,১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা শত শত নদীর মাধ্যমে বয়ে আসা পলি মাটি জমে তৈরি হয়েছে।
২০১০ সালে বাংলাদেশ দুর্যোগ ফোরাম এক সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষা সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত— এই ৫৭ বছরে দেশে শুকিয়ে গেছে ১৫৮টি নদী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের একদল গবেষক মৃতপ্রায় নদীর তালিকা তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাতে বলা হয়, দেশের ১১৫টি নদ-নদী শুকিয়ে গেছে।
অন্য দিকে নদী, পানি, প্রকৃতি নিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন উত্তরণের সমীক্ষা অনুযায়ী, গত ২০ বছরে (২০০০ থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত) দেশে ৪৩টি নদী শুকিয়ে গেছে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও নদীতে নানা অবকাঠামো নির্মাণ ও দখলের কারণে নদীর মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছেনা।
নদীর পানি প্রবাহ কমে গিয়ে এক দিকে যেমন শুকিয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে পানি দূষিত হওয়ার কারণেও মরে যাচ্ছে নদী। অনেক ক্ষেত্রে পানির প্রবাহ আছে ঠিকই, কিন্তু তা এমনভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে যে, নদীর পানি আর ব্যবহারের উপযোগী নেই। এসব নদীর মধ্যে শীর্ষে আছে বুড়িগঙ্গা, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী।
বাংলাদেশের প্রধান কয়েকটি নদী হলো পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলি, শীতলক্ষ্যা, গোমতী। দীর্ঘতম নদী সুরমা। ৩৯৯ কিলোমিটার এর দৈর্ঘ্য। সব থেকে চওড়া নদী যমুনা। দীর্ঘতম নদ ব্রহ্মপুত্র। গঙ্গোত্রী থেকে গঙ্গা, এর থেকে পদ্মা হয়ে সাগরে মিশেছে। আবার ব্রক্ষপুত্র থেকে যমুনা হয়ে সাগরে মিশেছে। লুসাই পাহাড় থেকে মেঘনার উৎপত্তি। বাংলাদেশের সব নদীর উৎপত্তি হিমালয় থেকে। একমাত্র সাংগু নদীর শুরু ও শেষ বাংলাদেশে।
বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বংশী, বালু, লৌহজঙ্গ কিংবা শীতলক্ষ্যার মতো নদীগুলোর দু’ধারে যে শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে, তার অপরিশোধিত বর্জ্য গিয়ে পড়েছে এসব নদীতে। ফলে বিষক্রিয়ায় মরে যাচ্ছে নদীর প্রাণ।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিমাখা কপোতাক্ষ নদ। আজ এ নদী একটা মৃতপ্রায় খাল। ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত, নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে। এসব নদীর এখন বেহাল দশা। অথচ পাঁচ দশক আগেও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি সরাসরি পান করা যেতো। আজ দূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, মাত্রাতিরিক্ত ক্লোরিন প্রয়োগ করেও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি শোধন করা যাচ্ছে না।
কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় উঠে আসা ধানসিঁড়ি নদী এখন শুকিয়ে কাল হয়ে গেছে। বড়াল নদীকে দেখলে এখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে এটি একটি নদী। চলন বিলের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া এই নদীর মাঝ বরাবর তৈরি করা হয়েছে একটি ক্রস-ড্যাম বা আড়ি-বাঁধ।
একই অবস্থা ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র, নেত্রকোনার মগড়া, কংশ ও সোমেশ্বরী, যশোরের ভৈরব, কপোতাক্ষ, ইছামতী, বেতনা, মুক্তেশ্বরী; কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা, ঘোড়াউত্রা, ফুলেশ্বরী; খুলনার রূপসা, শিবসা, ডাকি, আত্রাইয়ের মতো নদীগুলো এখন মৃত্যুর দিন গুনছে।
ফরিদপুরের কুমার, বগুড়ার করতোয়া, কুমিল্লার গোমতী, পিরোজপুরের বলেশ্বর, রাজবাড়ীর গড়াই, কুড়িগ্রামের ধরলা, গাইবান্ধার ঘাঘট, বান্দরবানের সাঙ্গু, খাগড়াছড়ির চেঙ্গী, নওগাঁর আত্রাই, জামালপুরের ঝিনাই নদীরও হয়েছে একই পরিণতি।
নদী কখনো মরে যায় না, খাত পরিবর্তন করে মাত্র। কিন্তু আমরা নদীর পানির উৎসসম্মুখ বন্ধ, ভরাট এবং দখল করে নদীকে মেরে ফেলছি। আমাদের কাছে নদীর প্রকৃত সংখ্যা এবং সেই নদীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-গভীরতা-পানির প্রবাহের গতি সবকিছুরই পরিসংখ্যান থাকলে একটি নদীকে কেউ সহজে মেরে ফেলতে পারত না। নদীর যেকোনো পরিবর্তন সূচিত হলে তখন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেত।
নদী আমাদের প্রকৃতির সুরক্ষা ও নান্দনিকতার জন্য বড় নিয়ামক। অথচ সরকার থেকে শু্রু করে জনগণ কেউ নদী সুরক্ষায় আন্তরিক নয়। বাংলাদেশের স্বাদু পানির নদী আমাদের বিশাল সম্পদ। বিশ্বব্যাপী স্বাদু পানির উৎস কমে যাচ্ছে, তাই উন্নত বিশ্ব নদ-নদী, খাল-বিল, জলাধার রক্ষা করছে আইন ও আন্তরিকতা দিয়ে।
সাজেদ/