প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২২, ২০২২, ১০:১৫ পিএম
চারিদিকে বিস্তীর্ণ নীল সমুদ্র, তার মাঝখানে ছোট্ট একটি সামুদ্রিক দুর্গ। এটিই এখন সিল্যান্ড নামে পরিচিত। বিশ্বের কোনো দেশ সিল্যান্ডের সার্বভৌমত্ব ও বৈধতার স্বীকৃতি না দিলেও এটিই সবচেয়ে ছোট রাষ্ট্র। মাত্র ৫৫০ বর্গ মিটারের এই রাষ্ট্রটি বর্তমানে পর্যটন ও বিভিন্ন মিউজিক ভিডিও ধারণের জনপ্রিয় স্থানে পরিণত হয়েছে। সিল্যান্ডে রয়েছে একটি মাত্র ভবন ও একটি হেলিপ্যাড। স্থায়ী বাসিন্দা ৪ জন।
কর্তৃপক্ষের দাবি অনুসারে, দেশটিতে ২৭ জন মানুষের আনাগোনা থাকলেও মাত্র চারজন স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ইন্টারনেটে সিল্যান্ডের নিজস্ব একটি ওয়েবসাইটও রয়েছে। সেখানে সিল্যান্ডের নানা স্মারক, ডাকটিকিট, মুদ্রা ইত্যাদি কিনতে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও কেউ চাইলে সিল্যান্ডের লর্ড, ব্যারন, কাউন্ট প্রভৃতি পদবী কিনতে পারবে। সেই সঙ্গে সিল্যান্ডের ভিসা করে দেশটি ঘুরে আসা সম্ভব।
ব্রিটিশ সমুদ্র উপকূল থেকে ছয় মাইল দূরে সিল্যান্ডের অবস্থান। প্রায় ৫০ বছর পুরনো এই সিল্যান্ডটি। এটি আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন কর্তৃক স্থাপিত একটি সামুদ্রিক দুর্গ। প্রথম দিকে একে ডাকা হতো ‘রাফস টাওয়ার’ নামে। এর কাজ ছিল শত্রু বিমানকে প্রতিহত করা, ইংল্যান্ডের জলসীমায় জার্মান মাইন বসানো পর্যবেক্ষণ করা ও তা সম্পর্কে রিপোর্ট করা। যুদ্ধের সময় এটি ছিল প্রায় ১৫০-৩০০ জন সৈন্যের আবাসস্থল। সেই সঙ্গে এখানে ছিল বিভিন্ন রাডারের যন্ত্রপাতি, দুটি ছয় ইঞ্চি বন্দুক, এবং দুটি ৪০ মি.মি. অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট অটোমেটিক কামান। ১৯৫৬ সালে রয়াল নেভি একে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে।
একটি বিশাল ডুবন্ত জাহাজের ওপরে সিল্যান্ডের এই অবকাঠামোটি গড়ে উঠেছে। ১৯৪২ সালে প্রথমে একটি ফেরির ন্যায় বিশাল ভাসমান সমতল জাহাজ নেয়া হয়। এর উপরে পাটাতনযুক্ত দুটি কংক্রিটের ফাঁপা টাওয়ার স্থাপন করা হয়, যাতে এর উপরে অন্যান্য কাঠামো তৈরি করা যায়। এই দুই টাওয়ারের প্রতিটি ছিল মোট সাততলা করে। এগুলো খাবার ও ঘুমানোর ঘর, গুদাম ঘর ও নানা যুদ্ধোপকরণ রাখার কাজে ব্যবহৃত হত।
এর নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর তিনটি টাগবোটের সাহায্যে একে ‘রাফ স্টান্ড’ বালুতটে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে নিয়ে আসার পর এটির সেই বিশাল সমতল জাহাজটিকে পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। ফলে সেটি উপরের গোটা কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। উপরে সমস্ত কাঠামোর ক্ষেত্রফল ১৫ গজ X ৪০ গজ।
যুদ্ধ শেষ হলে সিল্যান্ড আর কাজে আসে না। তখন রয়েল নেভি তাদের সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে এখান থেকে চলে যায়। ফলে এই অবকাঠামোটি কয়েক বছর পরিত্যক্ত হিসেবে পড়ে থাকে।
১৯৬৭ সালে এখানে একটি অবৈধ বেতার সম্প্রচারকারী দল আশ্রয় নেয়। তারা এই স্থানটি তাদের হেলিকপ্টারের ল্যান্ডিং প্যাড হিসেবে ব্যবহার শুরু করে এবং আরামে বসবাস শুরু করে। কিন্তু তাদের এই আরাম বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে আরেক অবৈধ বেতার সম্প্রচারকারী রয় বেটস আগের অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে স্থানটি দখলে নেয়। রয় বেটস-এর আগে ‘রেডিও এসেক্স’ নামের আরেকটি অবৈধ বেতার কেন্দ্র পরিচালনা করত। কিন্তু তা তিন মাইল ব্রিটিশ এলাকার মধ্যে হওয়ায় একসময় বেটস ধরা পড়ে যায় ও তাকে জরিমানা দিতে হয়। ফলে বেটস তার সমস্ত যন্ত্রপাতি ও ১৫ বছর বয়সী ছেলে মাইকেলকে নিয়ে রাফস টাওয়ারে এসে ওঠে ও দীর্ঘ এক লড়াইয়ের পর এটি দখলে নেয়।
সমুদ্র আইনে কিছু পরিবর্তন আসায় এই টাওয়ারটি আর পরিপূর্ণভাবে বেতারকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি। আর সেই পরিবর্তন অনুসারে ব্রিটিশ এলাকার বাইরের বেতার সম্প্রচারগুলো অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
এরপরও রয় বেটস দখলকৃত এই কৃত্রিম দ্বীপটি ছেড়ে যাননি। তিনি এর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন এবং একে ‘প্রিন্সিপ্যালিটি অফ সিল্যান্ড’ নামের এক সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন। তার এই ঘোষণার পেছনে কলকাঠি নাড়েন একজন উকিল। যিনি বেটসকে কীভাবে এটি স্থায়ীভাবে দখল করা যায়, সে বুদ্ধি দেন।
আসলে এই অবকাঠামোটির অবস্থান আন্তর্জাতিক জলসীমায়। আর পৃথিবীর কোনো দেশেরই এই আন্তর্জাতিক জলসীমার মালিকানা নেই। কোনো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেই এখানে। ফলে যে কেউ এখানে ইচ্ছা করলেই ঘাঁটি গেড়ে বসতে পারবে। এ ছাড়া এটি ছিল তৎকালীন ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাইরে। ফলে চাইলেও রয়েল নেভি এখানে কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারেনি।
এভাবেই যাচ্ছিল...। কিন্তু একদিন সিল্যান্ডের দিকে একটি ‘ব্রিটিশ ট্রিনিটি হাউজ’ জাহাজ এগিয়ে আসলে রয় বেটস জাহাজটির দিকে সতর্কীকরণ গুলি ছোড়েন। ফলে পরবর্তীতে বেটস ইংল্যান্ডে প্রবেশ করলেই তাকে গ্রেফতার করা হয়।
পরবর্তীতে রয় ও মাইকেল বেটসের নামে দায়েরকৃত এই মামলা আদালতে উত্থাপন করা হয়। তবে সিল্যান্ড ব্রিটিশ সীমানা ও বিচারব্যবস্থার বাইরে হওয়ায় বেটস পরিবারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া যাবে না বলে ঘোষণা দেন বিচারক। ফলে সে যাত্রায় বেঁচে যান বেটস।
কয়েক বছর বেশ শান্তিতেই কেটে যায়। এর মাঝে কিছু বিচ্ছিন্ন গ্রুপ ও চোরাকারবারি দল সিল্যান্ড দখল নেয়ার চেষ্টা করলেও রয় বেটস তাদের প্রতিহত করেন এবং তার এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেন।
১৯৭৫ সালে সিল্যান্ড থেকে এ রাজ্যের সংবিধান প্রকাশ করা হয়। ধীরে ধীরে কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, ডাক টিকিট, মুদ্রা ও পাসপোর্ট চালু করা হয়। সিল্যান্ডের জাতীয় প্রতীক ও সিলমোহরের নকশাও তৈরি করা হয়। সিল্যান্ডের জাতীয় নীতিবাক্য ‘E Mare Libertas’ অনুসারে, যার অর্থ, ‘সমুদ্র হতে, স্বাধীনতা’।
এর ঠিক ১০ বছর পর ১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে একটি জার্মান ও ডাচ হীরা ব্যবসায়ী দল রয় বেটসকে একটি ব্যবসায়িক কাজে অস্ট্রিয়াতে আমন্ত্রণ জানায়। অস্ট্রিয়ায় এসে পৌঁছলে রয় ও তার স্ত্রী জোয়ানকে পাঁচজনের একটি দল স্বাগত জানায় ও ব্যবসায়ীদের সম্মেলনে নিয়ে যায়। বেটস পরিবার সম্মেলনে পৌঁছান, তবে আলোচনা না হতেই সম্মেলনটি শেষ হয়ে যায়। এমন সন্দেহজনক আচরণে রয় বেটস সিল্যান্ডে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তবে সেখানে কোনো টেলিফোন কিংবা রেডিও না থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে তারা পার্শ্ববর্তী জেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন সিল্যান্ডে নাকি বিশাল এক হেলিকপ্টার অবতরণ করেছে। ফলে এক বিপদের সম্ভাবনা বাসা বাঁধে বেটস দম্পতির মনে।
এর কয়েকদিন পর মাইকেলের খোঁজ পান তারা। জানতে পারে- তারা সিল্যান্ড ত্যাগ করার কয়েকদিন পর রয়ের কাছ থেকে পাঠানো একটি চিঠি পৌঁছে দেয়ার নাম করে সিল্যান্ডে একটি হেলিকপ্টার অবতরণ করে। কিন্তু অবতরণের সঙ্গে সঙ্গেই তারা রয় কর্তৃক নিযুক্ত তৎকালীন সিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় গোটা সিল্যান্ড দখল করে নেয় এবং মাইকেলকে আটক করে। এরপর তারা মাইকেলকে খাদ্য ও পানীয়হীন অবস্থায় তিন দিন একটি কক্ষে আটকে রাখে এবং অবশেষে তাকে একটি ডাচ লঞ্চে করে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। লঞ্চটি মাইকেলের অর্থকড়ি ও পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে তাকে হল্যান্ডে ফেলে রেখে যায়।
এই ঘটনার পর পুনরায় পরিবারের সবাই একত্র হলে বেটস পরিবার কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও জনবল জোগাড় করেন। তাদের মধ্যে জেমস বন্ড সিনেমায় কাজ করা একজন পাইলটও ছিলেন। এরপর তারা সবাই মিলে সিল্যান্ড পুনরুদ্ধার অভিযানে রওনা হন। সেখানে পৌঁছানোর পর মাইকেল লুকিয়ে সিল্যান্ডের ডেকে শটগান হাতে নেমে পড়েন এবং কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়েন। এরপর খুব শিগগিরই সিল্যান্ড দখলকারী দল আত্মসমর্পণ করে।
পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাদের বহুদিন আটক করে রাখা হয়। এরপর তাদের নিজ নিজ দেশ থেকে মুক্তির আবেদন করা হলে সেই দেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এভাবে সিল্যান্ড ফিরে পায় তার স্বাধীনতা। এর বহু বছর পর ২০১২ সালে রয় বেটস মৃত্যুবরণ করেন।
সাজেদ/এএল