প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৮, ২০২২, ০৩:৪৯ এএম
কোনো দেশ বা জাতির ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আর শিল্পকর্মের উৎসই হলো জাদুঘর। এসব জাদুঘর শত-সহস্র বছরের প্রাচীন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্বের সব দেশেই জাদুঘর আছে। এমন বড় ও ঐতিহাসিক সুন্দর ১০টি জাদুঘরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরা হলো।
১. ব্রিটিশ মিউজিয়াম
শিল্পকর্ম, প্রত্নসামগ্রী ও কারুপণ্যের সংগ্রহ ও প্রদর্শনীর বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা ‘ব্রিটিশ মিউজিয়াম’। ১৭৫৩ সালের ৭ জুন যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে সরকারি উদ্যোগে তা স্থাপন করা হয়। ১৭৫৯ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে জনসাধারণের জন্য এটি উন্মুক্ত করা হয়।
এই জাদুঘরে মানব ইতিহাসের দুই মিলিয়ন বছরের অস্তিত্ব সংগ্রহ করা আছে। জাদুঘরে বিনামূলে সংগ্রহ অ্যাক্সেস দেখা যায়।
এই জাদুঘরের আরেক নাম ‘মিউজিয়াম অব স্টোলেন মাস্টারপিসেস’ ও ‘মিউজিক অব অল সিভিলাইজেশনস’। অর্থাৎ চুরি হওয়া অমূল্য জিনিসের জাদুঘর ও সব সভ্যতার জাদুঘর। এর কারণ সেখানকার ভাণ্ডার সৎ উপায়ে আসেনি। মিসরের নেপোলিয়নের সৈন্যদের কাছ থেকে ডাকাতি করে নেওয়া হয়েছে রোসেট্টা পাথর।
লন্ডন ছাড়াও সারাবিশ্বের পুরাকীর্তি ও ইতিহাস এখানে সংগৃহীত আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ এ জাদুঘর দেখতে আসেন। এখানে শুধু দেখা না বিভিন্ন সংগ্রহ সম্পর্কে দর্শনার্থিদের জানানো হয় প্রযুক্তির অভিনব ব্যবহার।
২. দ্য মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট
যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ও সেরা জাদুঘর ‘দ্য মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট’। এটি নিউ ইয়র্ক সিটির ফিফটি সেভেন্থ স্ট্রিট ও ফিফথ এভিনিউতে অবস্থিত। এখানে আছে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ওশেনিয়ান শিল্পকলার সংগ্রহশালা। এছাড়াও প্রস্তরযুগের প্রায় সব শিল্পকর্ম থেকে শুরু করে পপ আর্টের উদাহরণ মিলবে এই যাদুঘরে।
এই যাদুঘরের বিশেষত্ব হলো- সাত শতাব্দীর পাঁচ মহাদেশের অধিবাসীদের পরা পোশাকের সম্মিলন। বিভিন্ন দেশের শিল্পকর্ম ও স্থাপত্যের পাশাপাশি মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টে আছে বাদ্যযন্ত্র। তবে, আমেরিকার শিল্পকর্মই এর মূল আকর্ষণ।
২০১৬ সালে ৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন দর্শকদের সঙ্গে এটি বিশ্বের তৃতীয় পরিদর্শন শিল্প যাদুঘর এবং পঞ্চম সর্বাধিক পরিদর্শন করা জাদুঘর। এখানে রয়েছে প্রায় দুই মিলিয়ন স্থায়ী সংগ্রহ।
৩. দ্য লুভ্র, ফ্রান্স
বিশ্বের বৃহৎ শিল্পকর্ম নির্ভর ‘দ্য লুভ্র’ জাদুঘরটি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত। ফরাসি রাজাদের প্রাচীন দুর্গ ছিল এটি। এক লাখ ৯৫ হাজার বর্গমিটার জায়গা জুড়ে এর অবস্থান। এর মধ্যে ৬০ হাজার ৬০০ বর্গমিটার প্রদর্শনীর জন্য বরাদ্দ। ১৭৯৩ সালের ৮ নভেম্বর জাদুঘর হিসেবে এটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। রাজা ফিলিপ অগাস্টাস ১১৯০ খ্রিস্টাব্দে দুর্গটি গড়ে তোলেন।
প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস, ইসলামি শিল্প, সবই রয়েছে এখানে। এছাড়াও বিশ্বের খ্যাতিমান বেশিরভাগ চিত্রকরের আঁকা হাজারেরও বেশি সৃষ্টিকর্ম আছে লুভরে। এখানে আছে বিখ্যাত লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা ‘মোনালিসা’। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে ‘কোড অব হামমুরাবি’ কিংবা ফরাসি শিল্পী ইউজিন দ্যুলাকোঁয়ার আঁকা চিত্রকর্ম ‘লিবার্টি লিডি দ্য পিপল’।
৪. ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট
যুক্তরাষ্ট্রে যে কয়েকটি জাদুঘর আছে তার মধ্যে অন্যতম ‘ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট’। ওয়াশিংটনে অবস্থিত জাদুঘরটি ১৯৩৭ সালে তৎকালীন মার্কিন সরকারের দ্বিপাক্ষিক আইন পরিষদ ইউএস কংগ্রেস গড়ে তোলে। আমেরিকার সংগ্রাহক পল মেলন ও স্যামুয়েল হেনরিসহ অনেকের দান করা জিনিসইে এখানে স্থান পেয়েছে।
মধ্যযুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পশ্চিমা শিল্পকলার বিবর্তনের সাক্ষী এই জাদুঘর। ওয়াশিংটনের এই সুন্দর জাদুঘরটিতে সব মিলিয়ে এক লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি চিত্রকর্ম, ড্রয়িং ও ভাস্কর্য রয়েছে।
৫. সাংহাই সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মিউজিয়াম
চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ‘সাংহাই সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মিউজিয়াম’। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে চীনের সাংহাই শহরে এর উদ্বোধন করা হয়। মানবজাতি, প্রকৃতি, ও প্রযুক্তি থিম নিয়ে মতাদর্শগত অগ্রগতি ও আধুনিক বিজ্ঞানের প্রচারণা হয় এখানে।
জাদুঘরটি দুইটি শাখায় বিভক্ত। একটিতে প্রকৃতি ও জীবন নিয়ে বিভিন্ন বিষয়বস্তুর প্রদর্শনী। অন্যটিতে কম্পিউটার, রোবোটিক্স ও মহাশূন্যে ভ্রমণ বিষয়ক ইন্টারেক্টিভ।
এখানে ১৪টি প্রদর্শনী কক্ষ ও চারটি বিজ্ঞানভিত্তিক সিনেমা হল আছে। প্রদর্শনীর তালিকায় আছে- স্পেক্ট্রাম অব লাইফ, লাইট অব উইশডম, ওয়ার্ল্ড অব রোবটস ও স্পেস নেভিগেশন। প্রতিদিন এই জাদুঘরে হাজার হাজার দর্শনার্থী ঘুরতে আসেন।
৬. ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব চায়না
বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ও আধুনিক জাদুঘরের মধ্যে অন্যতম ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব চায়না’। এটি ২০০৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করা হয়। চীনের প্রাচীন ইতিহাস-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে দেশটির শেষ রাজবংশের সময়কার অনেক কিছুই রয়েছে এখানে। এতে স্থায়ীভাবে প্রায় এক কোটি পাঁচ লাখ আইটেমের সংগ্রহ রয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী তামার বস্তু এখানে আছে যা অন্য কোনো যাদুঘরে নেই।
এই জাদুঘরে আছে- শ্যাং রাজবংশের সিমুউ ডিং, বিশ্বের প্রাচীন ব্রোঞ্জওয়্যারগুলোর সবচেয়ে ভারী অংশ, বর্গাকার আকৃতির শ্যাং রাজবংশের ব্রোঞ্জ, ভেড়ার মাথা, বৃহত এবং বিরল খোদাই করা পশ্চিমের ঝো রাজবংশের ব্রোঞ্জের জলের প্যান, বাঘের আকৃতির একটি স্বর্ণের অন্তর্ভূক্ত কিন রাজবংশ ব্রোঞ্জ, হান রাজবংশের সোনার সুতার জেড স্যুট, রাজবংশের ত্রি-বর্ণের গ্ল্যাজড সানকাই, সং রাজবংশের সিরামিকগুলোর একটি বিস্তৃত সংগ্রহশালা।
৭. টেট মডার্ন
বিশ্বের আধুনিক ও সমকালীন শিল্পকলার সবচেয়ে বড় জাদুঘরের মধ্যে অন্যতম একটি ‘টেট মডার্ন’। ২০০০ সালে এটি গড়ে তোলা হয়। এই জাদুঘরটি যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক আধুনিক শিল্পকলার জাতীয় চিত্রশালাও বলা হয়। এটি জাদুঘর হলেও মূলত চিত্রশালা। এই জাদুঘরে ঊনিশ শতক থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের ব্রিটিশ ও আন্তর্জাতিক চিত্রকর্ম রয়েছে। এতে থিম ও বিষয়ভেদে নামযুক্ত আটটি স্থান রয়েছে।
স্প্যানিশ চিত্রকর পাবলো পিকাসো, ফরাসি শিল্পী অঁরি মাতিজ, স্প্যানিশ নকশাকর সালভাদর দালি ও জার্মান চিত্রকর ম্যাক্স আর্নস্টের গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিকর্ম রয়েছে এই জাদুঘরে। আমেরিকান শিল্পী অ্যান্ডি ওয়ারহল ও রয় লিশটেনস্টেইনের পপ আর্টও স্থান পেয়েছে এখানে।
৮. ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাদুঘর ‘ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম’। ১৯৪৬ সালে এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিকে আকাশযান ও নভোযানের ঐতিহাসিক বিজ্ঞানের গবেষণাগারও বলা হয়। এখানে প্রায় ৬০ হাজার উড়োজাহাজের মূল নমুনা রয়েছে। এগুলোর অবয়বেই তৈরি করা হতো প্রতিটি উড়োজাহাজ।
জাদুঘরটি দুটি ভবনে বিভক্ত। এর একটি ওয়াশিংটন ডি.সি মলে, অন্যটি ওয়াশিংটন ডুলেস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে উডভার-হ্যাজি সেন্টারে। জাদুঘরটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো- অ্যাপোলো ইলেভেন ও ফ্রেন্ডশিপ সেভেনের নমুনা আর এক পাখার বিমান ‘স্পিরিট অব সেন্ট লুইস’ ও বিশ্বের প্রথম বিমান আবিষ্কারক অরভিল ও উইলবুর রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের আকাশযান।
৯. দ্য ভ্যাটিকান মিউজিয়াম
ইতালির রাজধানী রোমে ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস স্থাপিত জাদুঘর কমপ্লেক্সের অংশ ‘দ্য ভ্যাটিকান মিউজিয়াম’। এটি বিশ্বের বড় জাদুঘরগুলোর একটি। এতে এক হাজার ৪০০টি হল ও ৫০ হাজার নিদর্শন আছে।
ভ্যাটিকান মিউজিয়ামের পুরোটা ঘুরে দেখতে হলে সাত কিলোমিটারেরও বেশি হাঁটতে হবে। এখানকার মূল আকর্ষণ সিস্তিনে চাপেল।
পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে অনেক দর্শনার্থী এ জাদুঘর দেখতে ছুটে আসেন। এখানে প্রাচীন সভ্যতার বিভিন্ন শিল্পকর্ম রয়েছে।
১০. ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি
বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি’। ১৯১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন, ডি.সি’তে এটি চালু হয়। এতে রয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি শিল্পকর্ম। এ শিল্পকর্মগুলো প্রাণীকূল, উদ্ভিদ জগত, ফসিলস, উল্কাপিণ্ড ও মানবসম্পদ নিয়ে করা।
জাদুঘরটির মূল ভবনের আয়তন এক লাখ ৪০ হাজার ২০০ বর্গমিটার। এর মধ্যে প্রদর্শনীর জন্য বরাদ্দ ৩০ হাজার ২০০ বর্গমিটার। সেখানকার জনপ্রিয় জিনিসের মধ্যে রয়েছে বিশাল তিমির রেপ্লিকা, কীট চিড়িয়াখানায় বিষাক্ত মাকড়সা ও স্যান্ট ওশান হৈলের বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী। জীববৈচিত্র্যের এই জাদুঘরে বিনামূল্যে প্রবেশাধিকার ও প্রতিদিন খোলা থাকে। ফলে, এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থীদের ভিড় জমে। ১৮৫ জন পেশাদার বিজ্ঞানী এর সঙ্গে যুক্ত আছেন।
সাজেদ/