প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৮, ২০২২, ১২:০৩ এএম
পৃথিবীটা বৈচিত্র্যে ভরপুর। এসবের আমরা ক’টাইবা জানি। বিশ্বের আনাচে-কানাচে মানুষের তৈরি স্তম্ভিত করার মত সৌন্দর্যের, অবিশ্বাস্য আকৃতির স্থাপত্যশৈলীর অনেকটাই আসলে অজানা। তবে মানুষের তৈরি এসব বিস্ময়কর সৃষ্টি এতটাই অবাক করার মতো যে, দেখলেও বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনই কয়েকটি অবিশ্বাস্য বিল্ডিং নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এ বিশেষ প্রতিবেদন।
দ্য মেরিনা বে স্যান্ডস স্কাইপার্ক, সিঙ্গাপুর (Marina BaySands Skypark) : ‘মেরিনা বে স্যান্ডস’ যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ আরেকটি শহর। এটি হচ্ছে সিঙ্গাপুরের একটি অত্যাধুনিক রিসোর্ট কমপ্লেক্স। ২০১০ সালে নির্মিত ৫৭ তলা বিশিষ্ট মেরিনা বে স্যান্ডস বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি একটি ৬ বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি। যার উচ্চতা ২০০ মিটার। এই ভবনটির ৫৭ তলায় অবস্থিত বন্দরমুখী পর্যবেক্ষণ ডেক হোটেলের মেহমানদের জন্য খুবই আকর্ষণীয় একটিস্থান। ভূমি থেকে ২০০ মিটার উপরের এ তলায় রয়েছে একটি ইনফিনিটিপুল। মেরিনা বে স্যান্ডসে রয়েছে আবাসিক হোটেল, বিশ্বের সেরা সব ব্র্যান্ডের শোরুম, কৃত্রিম আইস স্কেটিং কোর্ট, রেস্টুরেন্ট, কনভেনশন সেন্টার, থিয়েটার, জিমনেসিয়াম, শপিংমল, বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্যাসিনো, আর্ট সায়েন্স মিউজিয়াম। যার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে একটি খাল। এই স্কাই পার্ক থেকে একনজরে সমগ্র সিঙ্গাপুর দেখা যায়।
মেরিনা বে স্যান্ডস -এর মধ্যেই হেলিক্সব্রিজ, সিঙ্গাপুর ফ্লায়ার, মেরলিয়ন পার্ক, ক্লার্ক কোয়ায় এবং আর্ট সাইন্স মিউজিয়াম অবস্থিত। মেরিনা বে এর পাশেই গার্ডেন বাই দা বে অবস্থিত।
দি ডায়নামিক টাওয়ার (The Dynamic Tower) : ৪২০ মিটার উচ্চতার দি ডায়নামিক টাওয়ারের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০২০ সালের শুরুতে। ২০০৮ সালে এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ২০২০ সালে। আরব আমিরাতের দুবাইতে নির্মিত এই ভবনটির স্থপতি ইতালির নাগরিক আর্কিটেকচার ডেভিড ফিশার। ৮০ তলা এই বিল্ডিংটির প্রত্যেকটি তলাকে অবিশ্বাস্যভাবে ৩৬০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে ঘোরানো যায়।
যার কারণে বিল্ডিংটি প্রতিনিয়ত ঘুরতে থাকে। স্বাধীনভাবে ঘোরার কারণে টাওয়ারটির পরিবর্তিত আকার আসে। প্রতিটি ফ্লোর প্রতি মিনিটে সর্বোচ্চ ৬ মিটার বা ২০ ফুট ঘুরতে থাকে। একটি পূর্ণ ঘূর্ণন করার জন্য ১৮০ মিনিট সময় লাগে। প্রযুক্তির অভিনব ব্যবহারে তৈরি এ ভবনটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১.২ বিলিয়ন ডলার।
অ্যাগোরা টাওয়ার, তাইওয়ান (Agora Tower) : ২০ তলা বিশিষ্ট পরিবেশ বান্ধব এ টাওয়ারটি তাইপেই শহরের প্রাণকেন্দ্র জিনিতে অবস্থিত। বেলজিয়ান স্থপতি ভিনসেন্ট কালেবাউটের নকশায় বিল্ডিংটির নির্মিত হয়। এটির নির্মাণ কাজ ২০১৩ সালে শুরু হয়ে ২০১৭ সালে শেষ হয়। ভবনটিতে ৪০টি বিলাসবহুল এ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। যার প্রতিটির সাথে নিজস্ব ঝুলন্ত বাগান রয়েছে। ভবনটির বেসমেন্টে রয়েছে গাড়ী পার্কিং, সাঁতারের জন্য সুইমিং পুল, ফিটনেসের জন্য জিম,অন্যান্য সুবিধাদি। আলো ঝলমলে ভবনটির বেসমেন্টসহ সকল ফ্লোরের মেঝে কাঁচ দিয়ে তৈরি হওয়ায় অনন্য হয়ে উঠেছে।
দুটি হেলিকোডিয়াল টাওয়ার ৯০ ডিগ্রি মোচড়ের প্রভাব তৈরি ভবনটির মাঝের কাঠামোর সাথে সংলগ্ন রয়েছে। টাওয়ারটির আকৃতিতে রয়েছে অবিশ্বাস্য রকমের জ্যামিতিক আকার। বিল্ডিংটির প্রতিটি তলা ৪.৫ ডিগ্রি ঘোরানো রয়েছে। ইকো-ডিজাইন বৈশিষ্ট্যের সর্বোচ্চ ব্যবহারে টাওয়ারটিতে ১০,৭৬৩ বর্গফুটের একটি ফটোভোলটাইক ছাদ রয়েছে। যা সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করে ভবনটির বাসিন্দাদের চাহিদা মেটায়। এছাড়াও ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে বিল্ডিংয়ে বসবাসকারীদের খাওয়ার জন্য তা সরবরাহ করা হয়। এমন নকশার পিছনে মূলধারণাটি ছিল তাইপে শহরটিকে সবুজ ও পরিষ্কার হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করা। ২৩,০০০ গাছ এবং গুল্ম ব্যবহার করে পুরো বিল্ডিংটিকে সবুজ এলাকায় পরিণত করা হয়েছে। ভবনের অভ্যন্তরে কাঁচের মেঝেতেও গাছগুলো সুরক্ষিত রয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল সাংহাই ওয়ান্ডারল্যান্ড হোটেল, চীন (International Shanghai WonderlandHotel) : চীনের ইন্টারন্যাশনাল সাংহাই ওয়ান্ডারল্যান্ড হোটেলটি যেন গভীর খাদের মধ্যে একটি স্বর্গ! সাংহাই এর কাছাকাছি সংজিয়াং শহরে অবস্থিত। এই হোটেলটি পুরোটাই মাটির নীচে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১০০ মিটার গভীর খনির ৮০মিটার নীচে পর্যন্ত হোটেলটির নির্মাণ কাজ করা হয়েছে। হোটেলের বেশকিছুটা অংশ রয়েছে জলের নীচেও। আর এটাই এই হোটেলের প্রধান আকর্ষণ। ব্রিটিশ সংস্থা আটকিনস এই হোটেলের নকশা বানিয়েছে। এটির আরেকটি নাম রয়েছে ‘ডিপ পিট হোটেল’। ২১তলা হোটেলের ১৭টি ফ্লোর মাটির নীচে, দু’টি ফ্লোর জলের তলায় এবং দু’টি ফ্লোর মাটির উপরে। হোটেলটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের নভেম্বরে, আর শেষ হয় ২০১৮ সালের নভেম্বরে।
বিলাসবহুল এই অভিনব হোটেলে ছুটি কাটাতে পারবেন পর্যটকেরাও। এজন্য প্রত্যেক পর্যটককে গুণতে হবে দৈনিক ৪৮৯ থেকে ৫৪৬ ডলার পর্যন্ত। এ হোটেলে পর্যটকদের জন্য রয়েছে মোট ৩৩৭টি কক্ষ। হোটেলের মাঝখানে কাঁচের তৈরি কৃত্রিম জলপ্রপাত রয়েছে। হোটেলের নীচে দাঁড়িয়ে উপরে তাকালে মনে হবে, ঠিক যেন পাহাড়ের গা বেয়ে ৮০ফুট নীচে গভীর খাদে নেমে আসছে জলপ্রপাতটি।
আর্থ-স্ক্র্যাপার নামের এ হোটেলটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ২০০ কোটি ইউয়ান। ইন্টারন্যাশনাল সাংহাই ওয়ান্ডার ল্যান্ড হোটেলটি শিমাও কুয়ারি নামেও পরিচিত। দুইভাগে বিভক্ত হোটেলটিতে রয়েছে সর্বমোট ৪০০টি কক্ষ। সেই সঙ্গে রেস্টুরেন্ট, খেলাধুলার স্থান, বিনোদন আর সাঁতার কাটার সুইমিংপুল তো রয়েছেই। ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় এ হোটেলে শপিংমল ও রয়েছে। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার মধ্যে হোটেলটির ছাদে রয়েছে একটি বিশাল সবুজ মাঠ। ১০০০ জন ধারণ ক্ষমতার একটি কনফারেন্স হল, রেস্টুরেন্ট, ক্রীড়া ও সকল প্রকার চিত্তবিনোদন সুবিধা রয়েছে। এছাড়া হোটেলের সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে জলভিত্তিক সবধরনের ক্রীড়া সুবিধাসহ একটি আধুনিক সুইমিংপুল।
এই পাঁচতারকা হোটেলটির নকশা করেছেন অভিজ্ঞ চীনা স্থাপত্যবিদরা। এই চিত্তাকর্ষক ধারণাটি প্রথম নিয়ে আসে ব্রিস্টল ভিত্তিক Atkins ডিজাইন স্টুডিও। এই হোটেলটি নির্মাণ করতে কোন জমি ধ্বংস করা হয়নি। কারণ পুরো হোটেলটিই নির্মাণ হয়েছে একটি বিশাল খাদে। হোটেলটির সামনে রয়েছে একটি প্রাকৃতিক জলাধার। ঐ লেকের পানি গরম রাখা থেকে শুরু করে বিদ্যুত উৎপন্ন সবকিছু করা হয়েছে ভূ-তাপীয় শক্তি (Geothermal Energy) থেকে।
র্যাফেলস সিটি চংকিং, চীন (Raffles City Chongqing) : র্যাফেলস সিটি বিল্ডিংটি চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় চংকিং শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। এটি ইয়াংটজি এবং জিয়ালিং নদীর মোহনার সম্মুখভাগে নির্মিত হয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত আর্কিটেক্ট মোশে সাফদির নকশায় ও তত্ত্বাবধায়নে নির্মিত এটি একটি অবিশ্বাস্য স্থাপত্য নির্মাণশৈলী। ১১২ মিলিয়ন বর্গমিটারের আটটি টাওয়ার এবং একটি বিশাল সংযোগকারী স্কাইব্রিজ দিয়ে এ নির্মাণযজ্ঞ হয়েছে সম্পন্ন। র্যাফেলস সিটি চংকিং কমপ্লেক্সে একটি ২৩০০০০ বর্গমিটার শপিংমল, ১৪০০টি বিলাসবহুল আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট, একটি বিলাস বহুল হোটেল এবং ১৬০০০০ বর্গমিটার এলাকা অফিস স্পেস রয়েছে। এছাড়া এই সিটিতে অন্যান্য সকল সুবিধাদি সমেত বিশাল পরিবেশ বান্ধব খোলা জায়গা রয়েছে।
এই সিটির ৬ টি টাওয়ার সমান ২৮ তলা করে নির্মাণ করা হয়। এর ৪টি টাওয়ারের উপরে একটি গোলাকার স্কাই ভিউ বসানো হয়েছে। ফলে এটি এখন আর্কিটেকচারাল ডিজাইনের এক বিস্ময়কর সৃষ্টিতে পরিনত হয়েছে। বাকি চারটি টাওয়ারে হেলিপ্যাড রয়েছে। এই মেগাস্টাকচার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩.৮ বিলিয়ন ডলার। আর এটির কাজ শেষ হয়েছে ২০২০ সালে।
এক্সিড বিল্ডিং, জাপান (Xseed Building) : পৃথিবীর সর্বোচ্চ উঁচু বিল্ডিংয়ের মালিকানাটা এবার খুব সহসাই চলে যাচ্ছে জাপানের দখলে। এক্সিড বিল্ডিং নামে একটি মেগাপ্রকল্পে তৈরি হচ্ছে এই বিশাল ভবনটি। এটি এতোটাই উঁচু হবে যে এর উপর দিয়ে উড়োজাহাজও উড়তে পারবে না। আকাশচুম্বী এই ভবনটির উচ্চতা হবে ৪০০০ মিটার অর্থাৎ ৪ কিলোমিটার, প্রশস্ত হবে ৬ কিলোমিটার। সমুদ্রতীরে নির্মিতব্য এ ভবনটি হবে ৮০০ তলা বিশিষ্ট।
এই অককাঠামোটি তৈরি করতে ৩০ লাখ টনেরও বেশি ইস্পাত লাগবে। ভবনের নকশা ইতোমধ্যে অনুমোদিত হয়েছে। এই বিল্ডিং টিতে কমপক্ষে ১০লক্ষ মানুষ এক সঙ্গে থাকতে পারবে। আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে এই বিল্ডিংটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে।
পেনুমব্রা, ফ্রান্স (Penumbra) : ফ্রান্সে বসবাসরত এক ছাত্র হচ্ছেন টয়লাড শড। তিনি এমন অসাধ্য সাধন করেছেন, যা দেখে সবাই তার প্রশংসা শুরু করছে। তিনি একটি অভিনব উইন্ডোসিটি বানিয়েছেন। যে উইন্ডোটি সূর্যের আলোর সাথে সাথে নিজেকে এডজাস্ট করে নেয়।
এই উইন্ডোটি রোদ থেকে বাঁচতে এদিক ওদিক ঘুরতে থাকে। এই উইন্ডোটিতে সূর্যের আলো পড়লেই বন্ধ হয়ে যায় আবার নিজে থেকেই খুলে যায়।
সাজেদ/