• ঢাকা সোমবার
    ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

নবান্নের সুঘ্রাণ

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০২২, ০৪:১৬ এএম

নবান্নের সুঘ্রাণ

নবান্নের সুঘ্রাণ

মু আ কুদ্দুস

নবান্নের স্বাদ এখন আর নেই। এখনও খুঁজে ফিরি সেই নবান্ন উৎসব। আগে দেখতাম অগ্রহায়ণ-পৌষে নতুন ধান আসত, চার দিকে শুরু হতো সাজ সাজ রব। মুখিয়ে থাকত সবাই নতুন ধানের অপেক্ষায়, কখন আসবে ঘরে। যখন প্রতীক্ষার প্রহর শেষ, তখন বরণ করতে নেয়া হয় নতুন ধানের ঢালা। এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ঘাঁস চেঁছে বানানো হয় ধানের খোলা। পরিষ্কার করা হয় গোলাঘর। এরপর বড় ছেলের হাতে কেটে আনা একগুচ্ছ ধানের আঁটি টেনে রাখা হয় গোলাঘরের মুখে।  

আরও পড়ুনঃ পৃথিবী ধ্বংসের গুরুত্বপূর্ণ সব আলামত

রেওয়াজ ছিল, বাড়ির বড় ছেলেকে দিয়ে প্রথম একমুঠো পাকা নতুন ধান কেটে আনা হতো। যেদিন জমি থেকে একমুঠো নতুন ধান কেটে আনা হয়, তার সপ্তাহখানেক পর ওই জমির ধান কাটতেন কৃষকেরা। এরপর সেই ধান থেকে চাল তৈরি করে চলে নবান্নের আয়োজন। পাড়ার মোড়ল কিংবা নিকটজনদের দাওয়াত দেয়া হতো।

নতুন ধান থেকে বানানো চালের খির কিংবা পায়েস তৈরি করে বিলিয়ে দেয়া হতো পাড়ার সবাইকে। সন্ধ্যা হলে মিলাদ কিংবা অন্য ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের নিয়ম অনুযায়ী নবান্ন পালন করতেন। এখনও সেই রেওয়াজ আছে, তবে খুবই কম।

এখানে বলে নিতে চাই, জমি থেকে প্রথম একমুঠো ধান যখন কেটে আনা হতো তখন সেই ধানের আঁটিগুলো অতি পবিত্রতার সঙ্গে বেঁধে রাখা হতো গোলাঘরে (ধান যেখানে রাখা হয়)। নতুন ধান সেই গোলায় রাখা হতো। সারা বছরের খাবার বলেই মহান সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করেই এই নিয়ম মানা হতো। শত বছরের নিয়ম ছিল নবান্ন উৎসব। গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘরে নবান্ন উৎসব ছিল অন্য সব আনন্দের চেয়ে আলাদা। নবান্নের দিনে অনেকেই তাদের আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দিতেন। তবে মেয়ে-জামাই এরা কিন্তু বাদ পড়তেন না। যে বাড়িতে যেদিন নবান্ন আয়োজন হতো সেখানে ভাত-মাংসই শুধু নয়, নানা রঙের পিঠাও তৈরি হতো। আর এই নবান্ন জমে উঠত অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসের দিকে। হিমেল হওয়া আর মিষ্টি রোদ্দুর নবান্ন ঘরোয়া উৎসব জমে উঠত অমৃত ছোঁয়ায়। ওই সময় সারা বাংলায় সুখের আর আনন্দের ঢেউ বয়ে যেত। জমিতে কেউ ধান কাটছে, কেউ গরুর গাড়িতে ধানের আঁটি আনছে। আবার অন্যরা সারিবদ্ধভাবে ধান কাটছে। সকাল বেলা মুড়ি-মুড়কির ফেরিওয়ালা, ভাপাপিঠা, খেজুরের গুড়ের মোয়া। সবই ভেজালহীন খাবার। আজ এ সময়ে এসে আর সেই নবান্ন দেখি না। গ্রামেও কেউ ঘটা করে নবান্ন করে তা চোখে পড়ে না। কানেও আসে না নবান্নের কথা।

কালের বিবর্তনে গ্রামবাংলায় বাপ-দাদার আমলের সেই ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। শহরকেন্দ্রিক জমানায় নবান্নের উৎসব হয় দালান-কোঠার ভেতর। অথচ বহু বছর আগে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তার কবিতায় লিখেছিলেন- ‘মিলনোৎসবে সেও তো পড়েনি বাকি/নবান্ন তার আসন রয়েছে/পশ্চাতে চায় আমারই উদাস আঁখি/একবেণী হিয়া ছাড়ে না মলিন কাঁথা/’

তার এই কবিতার পর নতুন করে কিছু বলার বাকি থাকে না। নবান্নের ঘ্রাণ আজন্ম লালিত অন্তর্গত গহিনের উৎসবের আমেজে নতুন স্বপ্ন ডাকে। পাড়া-পড়শি, আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে এ উৎসব যে ব্যাপ্তি নিয়ে পালিত হয় তাকে কৃষকের উৎসব শুধু নয়, কৃষিনির্ভর মেহনতি মানুষের বছরের মূল শস্য উৎপাদনের পর এ এক লোক উৎসব।

 

বছরের মূল শস্য আহরণের এ সময় জমিতে অধিক শস্যপ্রাপ্তি, বৃষ্টি কামনা এবং সন্তান ও পশুসম্পদের আকাঙ্ক্ষায় আদি যুগে এ ধরনের উৎসব চালু ছিল- যা ঊনবিংশ শতকেও ছিল চলমান। এখন সেটি আর নেই। আর নবান্ন নিয়ে প্রতিটি ধর্মের মানুষ তাদের নিয়মানুযায়ী পালন করত, এটি আগেও বলেছি। যেমন সাঁওতালরা নবান্ন পালন করত সাত দিন। এ সাত দিনেই তারা গানবাজনা করত। উসুই নামে এক গোষ্ঠী, অন্নদাত্রী লক্ষ্মীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে মাইলুকমা উৎসব পালন করে। জুমচাষি স্রো উপজাতি চামোইনাত নবান্নে মুরগি বলি দিয়ে নতুন ধানের ভাত সবাইকে খাইয়ে দেয়। অনেকে নবান্নের দিনে নতুন ধানের পিঠা-পায়েস করে অন্যদের ঘরে বিলিয়ে দেয়। তবে আদিবাসীদের মধ্যে নবান্নের আয়োজন হয় বিশাল করে। বাঙালিরাও এ থেকে পিছিয়ে ছিল না।

কবির ভাষায় বলি, ‘আঁচলের ঘ্রাণের মতো ধানের ঘ্রাণ। ওগো হেমন্তের মেয়ে আমি তোমার দ্বারে আমার ছায়ার সমান অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। তোমার শরীরের নবান্ন ঘ্রাণ বড্ড নাকে লাগছে। ধূপময় গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিদিক। পাকা আমন ধানের চিঁড়া লাগে। এই নবান্নে আমাকে তুমি গ্রহণ করো।’

আবার কখনও এই নবান্নকে উপমা করে প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমি নবান্নের উৎসব নিয়ে তোমার কপালে এঁকে দেবো ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের টিপ।’ তবে নবান্নকে ঘিরে অনেকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আমি এই মুহূর্তে বলতে চাই যে, নবান্নে উচ্ছ্বাস ছিল। যে নবান্নে সৃষ্টির দান ছিল, যে নবান্নে সারা বছরের খাবার পাওয়া যেত- পাওয়া যেত নতুন ধানের আলাদা একটা গন্ধ। এখন ধান আছে, জমি আছে, কৃষকও আছে, নাই কেবল সেই নবান্নের উৎসব।’

নবান্ন হারিয়ে ফেলেছি আমরা- কোন এক দূরদেশে/যেখানে ছিল পাখ-পাখালির গুঞ্জন। ছিল নদীর বয়ে যাওয়া কুলকুল ধ্বনি। এখন সবাই খুঁজে ফিরি সেই দিন- যেদিন ধানের গন্ধে, ছিল মহুয়া মাতাল সুবাসের হাঁড়ি। কাকে দিবো সেই বাড়ি- যেখানে ছিল নিত্য নবান্নে সুঘ্রাণ।

 

 

 সাজেদ/

আর্কাইভ