প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৩, ২০২২, ০১:২০ এএম
‘ও কি গাড়িয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে..........।’ এখন চাইয়া থাকলেও গ্রামীণ জনপদের আঁকাবাঁকা মেঠো পথে ধীরে ধীরে বয়ে চলা গরুর গাড়ি আর চোখে পড়ে না। যা এক সময় আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাহন হিসেবে প্রচলিত ছিল এবং যোগাযোগের একমাত্র অবলম্বন ছিল। কালের পরিক্রমায় আধুনিকতার স্পর্শে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী সেই গরুর গাড়ি এখন শুধুই স্মৃতি। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে গাড়িয়াল পেশাও। যা একদা ছিল বংশ পরম্পরায়।
কালের বিবর্তনের সাথে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের ধারকবাহক অনেক বাহনেরই আমূল পরিবর্তন, আধুনিকায়ন হয়েছে। আজ শহরের ছেলে-মেয়েরা তো দূরে থাক গ্রামের ছেলে-মেয়েরাও গরুর গাড়ির সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নয়।
আরও পড়ুনঃ সুস্বাদু খাবার সিঁদুল এবং প্যালকা
উত্তরাঞ্চলের জনপদে কৃষি ফসল বহন ও মানুষ বহনের প্রিয় বাহন ছিল দু-চাকার গরুর গাড়ি। এখন এসব বাহন রূপকথার গল্পমাত্র এবং বিলুপ্ত হয়ে স্থান পেয়েছে সংবাদপত্র ও বইয়ের পাতায়। মাঝেমধ্যে প্রত্যন্ত এলাকায় দু-একটি গরুর গাড়ি চোখে পড়লেও শহরাঞ্চলে একেবারেই দেখা যায় না। আধুনিক সভ্যতায় ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি হারিয়ে যেতে বসেছে।
প্রাচীনকাল থেকে দেশের গ্রামীণ জনপদে বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য ও ফসল বহনের কাজে গরুর গাড়ির বহুল প্রচলন ছিল। বিভিন্ন উৎসব পার্বণে এটি ছিল অপরিহার্য। গরু গাড়ি দুই চাকাবিশিষ্ট গরু বা বলদে টানা এক প্রকার বিশেষ যান। এ যানে সাধারণত একটি মাত্র অক্ষের সাথে চাকা দুটি যুক্ত থাকে। গাড়ির সামনের দিকে একটি জোয়ালের সাথে দুটি গরু বা বলদ জুটি মিলে গাড়ি টেনে নিয়ে চলে।
গরুর গাড়ির চালককে বলা হয় গাড়িয়াল। সাধারণত গাড়িয়াল বা চালক বসেন গাড়ির সামনের দিকে। আর পেছনে বসেন যাত্রীরা। আর তাই চালককে উদ্দেশ্য করে রচিত হয়েছে হৃদয় ছুয়ে যাওয়া গান, ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, আস্তে বোলাও গাড়ি, আরেক নজর দেখিবার নাও মুই দয়ার বাপের বাড়িরে গাড়িয়াল’।
গরুর গাড়ির ইতিহাস ও ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। অনুমান করা হয়, নব্যপ্রস্তর যুগ থেকেই মানুষ এই বাহন ব্যবহার করে আসছে। ফ্রান্সের ফঁতান অঞ্চলের আল্পস পর্বতের উপত্যকায় একটি গুহায় গরুর গাড়ির ছবি পাওয়া যায়। তা থেকে জানা যায়, খ্রিস্টের জন্মের ৩১০০ বছর আগে ব্রোঞ্জ যুগেও গরুর গাড়ির অস্তিত্ব ছিল। হরপ্পা সভ্যতাতেও যে গরুর গাড়ির অস্তিত্ব ছিল তার সপক্ষে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখানেও নানা অঞ্চল থেকে এক অক্ষবিশিষ্ট চাকাওয়ালা নানা খেলনা পাওয়া গেছে। এগুলো থেকে বিশেষজ্ঞদের অনুমান খ্রিস্ট জন্মের ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ বছর আগেই সিন্ধু অববাহিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল। যা সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে দক্ষিণেও ছড়িয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন জনপ্রিয় উপন্যাসেও দক্ষিণ আফ্রিকার যাতায়াত ও মালবহনের উপায় হিসেবে গরুর গাড়ির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ‘এইচ রাইডার হ্যাগার্ড’-এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘কিং সলোমনস মাইনস’ নামক উপন্যাসেও গরুর গাড়ি সম্বন্ধে বর্ণনা রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বের প্রলয়ংকরী সব ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত দেশ
গরুর গাড়ি মাত্র দুই যুগ আগেও যাতায়াত, পণ্য পরিবহন ছাড়াও বিয়ের বর-কনে বহনের কাজে ব্যবহৃত হতো। গরুর গাড়িতে চড়ে বর-বধূ যেত। বিয়ে বাড়ি বা মাল পরিবহনে গরুর গাড়ি ছিল একমাত্র বাহন। বরপক্ষের লোকজন বরযাত্রী ও ডুলিবিবিরা বিয়ের জন্য ১০ থেকে ১২টি গরুর গাড়ির ছাউনি (টাপর) সাজিয়ে শ্বশুরবাড়ি ও বাবার বাড়ি আসা-যাওয়া করতো। রাস্তাঘাটে গরুর গাড়ি থেকে পটকাও ফুটাত। এছাড়া বিয়ের সময় বর-কনে উভয় পক্ষই গরুর গলায় ঘণ্টা লাগিয়ে বিয়ে বাড়িতে যেতো। সারিবদ্ধ গরুরগাড়ী সে এক অপরূপ শোভা সৃষ্টি হত সে সময়। সেই দৃশ্য দেখতে গ্রামের শিশু, কিশোর ও নারী-পুরুষেরা বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসতো রাস্তার ধারে। এমন দৃশ্যের কথা এখন ভাবাই যায় না।
একসময় গরুর গাড়ী প্রতিযোগিতাও হত একেক এলাকার খোলা মাঠে। ওই খেলাটিও হারিয়ে গেছে কালের আবর্তনে।
গরুর গাড়িতে কখনো জৈব সার (গোবর সার), কখনো গরুর খাবার ও লাঙল-মই-জোয়াল নিয়ে মাঠে যেত। ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটারের রাস্তা পাড়ি দিয়ে কৃষকেরা জমি চাষাবাদ এবং মালামাল বহনের জন্য গরুর গাড়ি বাহন হিসেবে ব্যবহার করতো।
একটা সময় প্রতিটি পরিবারেই একটি করে গরুর গাড়ি ছিল। অনেক বিত্তবান পরিবারে ৩/৪টি পর্যন্ত গরুর গাড়ি ছিল। সে সময়ে অধিকাংশ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন ছিল গরুর গাড়ি। এই গাড়ির ওপর নির্ভর করে চলত ওইসব পরিবারের সংসার। গ্রামের বউ-ঝিদের নাইওর যেতে গরুর গাড়ি ব্যবহৃত হতো অহরহ।
তবে বর্তমানে নানা ধরনের মোটরযান চলাচলের কারণে অপেক্ষাকৃত ধীর গতির এই যানটির ব্যবহার এখন আর চোখে পড়ে না। এখন ব্যবহার করছে ট্রাক, পাওয়ার টিলার, লরিসহ বিভিন্ন মালবাহীগাড়ি। যাতায়াতের জন্য ব্যবহার হচ্ছে ট্রেন, বাস, মাইক্রোবাস, কার, বেবিট্যাক্সি, অটোরিকশা, ভটভটি, নছিমন-করিমন, রিক্সা ভ্যানসহ ইঞ্জিনচালিত নানান বাহন।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ১০টি বিমান দুর্ঘটনা
গরুর গাড়ি একটি পরিবেশবান্ধব যান। এতে কোনো জ্বালানি খরচ নেই। শব্দ দূষণ নেই। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ এসব কিছুই এই যানে ব্যবহার হয় না। ফলে ধোঁয়া হয় না। পরিবেশের কোনো ক্ষতিও করে না। এই গরুর গাড়ি ধীর গতিতে চলে বলে তেমন কোনো দুর্ঘটনাও নেই। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে আমাদের প্রিয় এই গরুর গাড়ি প্রচলন হারিয়ে যাচ্ছে।
সাজেদ/