• ঢাকা সোমবার
    ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

বিশ্বের প্রলয়ংকরী সব ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত দেশ

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০২২, ১০:৪৯ পিএম

বিশ্বের প্রলয়ংকরী সব ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত দেশ

বিশ্বের প্রলয়ংকরী সব ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত দেশ

ফিচার ডেস্ক

ভূ-অভ্যন্তরে শিলার পীড়ন ক্ষমতা সহ্যসীমার বাহিরে চলে গেলে শিলায় ফাটল ধরে ও শক্তির মুক্তি ঘটে। তাতে ভূ-পৃষ্ঠ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। ভূমিকম্পের সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে, এটি পূর্বাভাস ছাড়াই সংঘটিত হয়। মুহুর্তে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ডে হাজারো প্রাণের মৃত্যু ঘটে। ধরাশায়ী হয় বহুতল ভবন। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ধ্বংস্তুপে পরিনত হয় লোকালয়। 

ভূমিকম্পের আগাম খবর মানুষ জানতে পারে না। এ কারণেই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয় বেশি। ভূমিকম্প ঘটার আগাম সংকেত পাওয়ার উপায় আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। তবে পশুপাখি নাকি টের পায়। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা না পাওয়া গেলেও এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে ভূরি ভূরি।

আরও পড়ুনঃ বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ১০টি বিমান দুর্ঘটনা

বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে যে বিদ্যুৎ নিঃসরিত হয়েছিল, তা দিয়ে গোটা যুক্তরাষ্ট্রের সব বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তিন দিনের যাবতীয় বৈদ্যুতিক কাজ করা সম্ভব।

আচানক এসে মরণ আঘাত হানে বলেই ভূমিকম্প নিয়ে মানুষের যেমন ভয় রয়েছে, তেমনি রয়েছে অনেক কৌতূহল। এখানে মৃত্যু বিচারে বিশ্বের শীর্ষ কয়েকটি ভূমিকম্পের তথ্য দেওয়া হলো:

১৯২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর জাপানে ‘দ্য গ্রেট কানতো’ নামের ভয়াবহ এক ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে অগ্নিকাণ্ড ও সুনামির ঘটনা ঘটে। দেড় লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই চীনের তাংশানে আঘাত হানা ভূমিকম্পে এক লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে। ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পটি হয়েছে চীনেই। ১৫৫৬ সালের এই ভূমিকম্পে আট লাখ ৩০ হাজার লোকের প্রাণ ঝরে যায়। ১৯৬০ সালের ২২ মে চিলিতে আঘাত হানা ভূমিকম্পটি ছিল সবচেয়ে তীব্র। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ছিল ৯.৫। এতে সুনামি হয়েছিল। ৩০০ থেকে দুই হাজার লোক মারা যায় বা নিখোঁজ হয়।

এশিয়ার অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ ইরান। ১৯৭২ সাল থেকে সে দেশে ১১টি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এরমধ্যে সবচয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পটি আঘাত হানে ১৯৯০ সালের ২১ জুন। এতে প্রায় ৫০ হাজার লোক নিহত হয়। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারায়। এই উপমহাদেশে পাকিস্তান ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। সে দেশে সত্তরের দশক থেকে এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে ৪০ টির বেশি ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পটি আঘাত হানে ২০০৫ সালের ৮ অক্টোবর। রিখটার স্কেলে তীব্রতা ছিল ৭.৬। ডন অনলাইনের তথ্যমতে, কাশ্মীরসহ উত্তরাঞ্চলীয় এলাকায় আঘাত হানা এই ভূমিকম্পে ৮০ হাজারের বেশি লোক নিহত হয়। আহত হয় দুই লাখের বেশি মানুষ। ঘরবাড়ি হারায় ৪০ লাখ লোক। ভারতেও ভূমিকম্পের ঘটনা কম নয়। ২০০১ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসে গুজরাট রাজ্যে শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প নাড়া দিয়ে যায়। এতে প্রায় ৩০ হাজার লোক প্রাণ হারায়।

ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান মাত্রার বিচারে বিশ্বের শীর্ষ ১০ ভূমিকম্পের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। নিচে দেওয়া হলো সেসব বড় ভূমিকম্পের কথা :

আরও পড়ুনঃ বিশ্বের ভয়ঙ্করতম নরখাদক রাতু উদ্রে

১. চিলি, ২২ মে ১৯৬০ : মাত্রা—৯ দশমিক ৫

এটাকেই এখন পর্যন্ত বলা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মাত্রার ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে ৯ দশমিক ৫ মাত্রার এই ভূমিকম্পে চিলিতে মারা গিয়েছিল চার হাজার ৪৮৫ মানুষ। আহত হয়েছিল ২০ লাখের বেশি। ১৯৬০ সালে লাতিন আমেরিকার দেশ চিলির দক্ষিণাঞ্চলে এই শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল। এই ভূমিকম্পে পুয়ের্তো সাভেদ্রা নামে একটি সমুদ্রবন্দর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এই ভূমিকম্পের ফলে সাগরে সুনামির সৃষ্টি হয়। সুনামিতে সৃষ্ট ঢেউয়ের কবলে পড়ে ফিলিপাইন ও জাপানে মারা গিয়েছিল আরো ১৭০ জন।

How many Deaths - valdivia Chile 1960 Earthquake

২. প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ড, আলাস্কা, ২৪ মার্চ ১৯৬৪ : মাত্রা—৯ দশমিক ২

এই ভূমিকম্পের ফলে আলাস্কায় ভয়ংকর ভূমিধসের সৃষ্টি হয়েছিল। এতে সাগরে সুনামিরও সৃষ্টি হয়। মৃতের সংখ্যা ছিল ১২৮ জন আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩১ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার।

1964 Alaska earthquake - Wikipedia

৩. উত্তর সুমাত্রার পশ্চিম উপকূল, ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ : মাত্রা-৯ দশমিক ১

ভূমিকম্পের সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার একটা সম্পর্ক রয়েছে, এটাই সুনামি নামে পরিচিত। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী সুনামি বলা হয় ২০০৪ সালে, একটি ৯ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পের পর। এশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার ১৪টি দেশে অনুভূত হয়েছিল এই ভূমিকম্প ও সুনামি। এই সুনামিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ইন্দোনেশিয়া; এক লাখ ৭০ হাজার মানুষ এতে প্রাণ হারায়। অনেক মৃতদেহই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মৃতের সংখ্যা নিরূপণ করতে কয়েক মাস সময় লেগে যায়। ইন্দোনেশিয়ার মৎস্য শিল্প ও কারখানার প্রায় ৬০ শতাংশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় এই সুনামিতে।

সমুদ্রগর্ভের ৩০ কিলোমিটার নীচে ছিল ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু৷ নয় দশমিক এক থেকে নয় দশমিক তিন শক্তির জোরালো ভূকম্পন৷ শুধু তাই নয়, ভূকম্পন চলে প্রায় আট-দশ মিনিট ধরে, যা কিনা একটা রেকর্ড৷ সারা ভূগোলক নাকি এক সেন্টিমিটার কেঁপে যায়৷ বিজ্ঞানীরা এই ভূমিকম্পের নাম দিয়েছেন সুমাত্রা-আন্দামান ভূমিকম্প৷

ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট সুনামি বিশ্বের ১৪টি দেশে প্রায় দু‍‍`লাখ ত্রিশ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটায়৷ সুনামির জলোচ্ছ্বাস কোথাও কোথাও ৩০ মিটার অবধি উঁচু হয়ে বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ে, বাড়িঘর ধ্বংস করে মানুষজনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়৷

ইতিহাসের ভয়াবহ ১০ ভূমিকম্প যা মানবজাতি আজও স্মরণ করে

৪. কামচাটকা, ৪ নভেম্বর ১৯৫২ : মাত্রা-৯

রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যে আঘাত হেনেছিল শক্তিশালী এই ভূমিকম্প। এর ফলে প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্টি হয়েছিল সুনামি। কামচাটকা উপদ্বীপ ছিল এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল। তিন হাজার মাইলজুড়ে অনুভূত হয়েছিল এই ভূকম্পন, যা রাশিয়ার দূরপ্রাচ্য ও হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে অনুভূত হয়েছিল। তবে এই ভূমিকম্পে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। পেরু ও চিলিতেও আঘাত হেনেছিল এই ভূমিকম্প।

এক শতকের বড় ভূমিকম্প

৫. আরিকা, পেরু (বর্তমান চিলি), ১৩ আগস্ট ১৮৬৮ : মাত্রা-৯

প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট এই ভূকম্পন হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত অনুভূত হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকার আরেকুইপা শহর। সেখানে মারা যায় ২৫ হাজার মানুষ। বলিভিয়ার লা পাজ শহরেও অনুভূত হয়েছিল ভূকম্পন। প্রথম আঘাত হানার চার ঘণ্টা পর ভূমিকম্পটির আফটার শক আঘাত হানে সমুদ্রে। এতে ১৬ মিটার উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়েছিল সৈকতে।

2004 Indian Ocean earthquake and tsunami: Facts, FAQs, and how to help |  World Vision

৬. যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল, ২৬ জানুয়ারি ১৭০০ : মাত্রা-৯ (আনুমানিক)

অনেক আগের এই ভূমিকম্পের কোনো দালিলিক প্রমাণ না থাকলেও উত্তর আমেরিকার বাসিন্দারা মুখে মুখে শুনেছেন এই ভূমিকম্প এবং তার ক্ষয়ক্ষতির কথা। উত্তর আমেরিকা মহাদেশের অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্প মনে করা হয় এটিকে। ভ্যাঙ্কুভার দ্বীপের পাচেনা উপকূলে বসবাস করা জনগোষ্ঠী সুনামিতে সৃষ্ট ঢেউয়ের কারণে তলিয়ে গিয়েছিল।

Seismic Zone Off Alaska Could Trigger Massive Earthquake and Tsunami | Live  Science

৭. চিলি, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০ : মাত্রা-৮ দশমিক ৮

সপ্তদশ শতক থেকেই চিলিতে ছোট-বড় ভূমিকম্প অনুভূত হয়ে আসছে। ২০১০ সালের এই ভূমিকম্পে প্রাণ হারান ৫২১ জন মানুষ। আহত হন অন্তত ১২ হাজার। আট লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন।

Months of Gravity Changes Preceded the Tōhoku Earthquake - Eos

৮. ইকুয়েডরের উপকূল, ১৩ জানুয়ারি ১৯০৬ : মাত্রা-৮ দশমিক ৮

ইকুয়েডর ও কলম্বিয়ার সমুদ্র উপকূলে সৃষ্ট এই সুনামিতে মারা যায় পাঁচ শতাধিক মানুষ। আহত হয় আরো দেড় হাজার। মধ্য আমেরিকা ও সানফ্রান্সিসকোতেও অনুভূত হয় এই ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের প্রভাবে হাওয়াইয়ের নদীগুলো প্লাবিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল।

New model aims to help improve resilience to subduction zone earthquakes -  Temblor.net

৯. লিসবন, ১ নভেম্বর ১৭৫৫ : মাত্রা-৮ দশমিক ৭

পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে আঘাত হানা শক্তিশালী এই ভূমিকম্পে শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। ভূকম্পনের ফলে সৃষ্ট সুনামি এবং অগ্নিকাণ্ড পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ করে তোলে। উত্তর আমেরিকা, ফ্রান্স ও উত্তর ইতালিতে অনুভূত হয়েছিল এই ভূমিকম্প।

Lisbon earthquake of 1755 | Portugal | Britannica

১০. আসাম-তিব্বত, ১৫ আগস্ট ১৯৫০ : মাত্রা-৮ দশমিক ৬

ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে আসাম-তিব্বতের ৭০টি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ভারতের আসাম প্রদেশ।

7.3 magnitude earthquake under sea hits Indonesia, Tsunami warning issued |  Earthquake: সমুদ্রগর্ভে ৭.৩ মাত্রার ভূমিকম্প, জারি হল Tsunami সতর্কতা

 এতে মারা যায় এক হাজার ৫২৬ জন মানুষ। ভূমিকম্পের পরে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়।

 

 

 সাজেদ/

আর্কাইভ