প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০২২, ১১:৪২ পিএম
বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছে ‘পবিত্র কুরআন শরীফ’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনের প্রতিটি আয়াত নাজিলের সঙ্গে সঙ্গেই নবীজি (সা.)-এর সাহাবিরা তা মুখস্থ করে ফেলতেন। অনেকে লিখেও রাখতেন। পরবর্তী সময়ে নবীজি (সা.)-এর মৃত্যুর পর খোলাফায়ে রাশেদানের সময়ে কোরআন শরিফ একত্রিত করা হয়।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে লেখা কুরআন শরীফের কোনো পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া না গেলেও বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাদুঘরে, গ্রন্থাগারে কুরআন শরিফের এমন কয়েকটি পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে, যেগুলো রচিত হয়েছিল নবীজি (সা.)-এর মৃত্যুর পর প্রথম কিংবা দ্বিতীয় শতকেই। সেই সময়ের পবিত্র কুরআন শরীফ কীভাবে সংরক্ষণ এবং পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে জানার চেষ্টা করবো।
আরও পড়ুন: নমরুদের মৃত্যু দুঃসহ যন্ত্রণায়
বার্মিংহাম পাণ্ডুলিপি : কুরআন শরিফ নাজিল হয়েছিল ৬০৯ থেকে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত কুরআন শরিফের দুটি পাতাকে কুরআনের প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপি বলা হয়। রেডিওকার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ৯৫.৪ শতাংশ নিশ্চয়তা দিয়ে দাবি করেছেন, এই পাণ্ডুলিপিটি লেখা হয়েছিল ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। ধারণা করা হয়, এটি নবীজি (সা.)-এর জীবিত অবস্থায় কিংবা তার মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই এগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল।
পাণ্ডুলিপির দুটির পাতার মধ্যে একটিতে সূরা আল-কাহফের ১৭-৩১ আয়াত, অন্য পাতায় আছে সূরা মারিয়ামের ৯১-৯৮ আয়াত এবং সূরা তাহার ১-৪০ আয়াত। বলা হয়, পাণ্ডুলিপিটি লেখা হয়েছিল গরুর বাছুর, ছাগল কিংবা ভেড়ার চামড়া থেকে প্রস্তুতকৃত কাগজের ওপর। যাতে হিজাজি লিপি অনুসরণ করা হয়েছে। এর পৃষ্ঠাগুলো দৈর্ঘ্যে ৩৪.৩ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থে ২৫.৮ সেন্টিমিটার।
সানায় পাণ্ডুলিপি : ১৯৭২ সালে ইয়েমেনের গ্রেট মস্ক অফ সানার একটি দেয়াল ধসে পড়ে। এরপর সেটি সংস্কার করার সময় মাটির নিচে গোপন একটি কুঠুরিতে প্রচুর প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ৮১টি পাতাকে কুরআন শরীফের পাণ্ডুলিপি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
আরও পড়ুন: শয়তানের ত্রিভুজ থেকে ফিরেনি যে জাহাজ
কুরআন শরীফের অন্য সব প্রাচীন পাণ্ডুলিপির তুলনায় সানার পাণ্ডুলিপিটি একেবারেই ভিন্ন। চামড়া থেকে তৈরি পার্চমেন্টের ওপর এখানে একই সঙ্গে দুটি লেয়ারে ভিন্ন দুটি পাণ্ডুলিপির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ একই কাগজের ওপর প্রথমে একবার কুরআন লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল; কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোনো কারণে সেই কালি মুছে ফেলা হয় এবং তার ওপর আবারও নতুন করে কুরআন শরীফ লিপিবদ্ধ করা হয়। পুরনো লিপির কালিতে লৌহচূর্ণের উপস্থিতি থাকায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ছায়ার মতো করে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
রেডিওকার্বন ডেটিং থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে গবেষকরা দাবি করেছেন, ৬৮ শতাংশ সম্ভাবনা আছে পাণ্ডুলিপিটি রচনা করা হয়েছিল ৬১৪ থেকে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। ৯৫ শতাংশ সম্ভাবনা আছে এটি রচিত হয়েছিল ৫৭৮ থেকে ৬৬৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। অর্থাৎ পাণ্ডুলিপির প্রাচীন লিপিটি নবীজি (সা.)-এর জীবদ্দশায় কিংবা তার মৃত্যুর প্রথম কয়েক দশকের মধ্যেই লেখা হয়েছে।
তুবিনজেন পাণ্ডুলিপি : তুবিনজেন ফ্র্যাগমেন্ট নামে পরিচিত কুরআন শরিফের এ পাণ্ডুলিপিটি বর্তমানে সংরক্ষিত আছে জার্মানির তুবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় দামেস্কে নিযুক্ত প্রুশিয়ার কনসাল জোহান গটফ্রাইড ওয়েট্জস্টাইন এটি সংগ্রহ করেছিলেন; যা পরবর্তী সময়ে অন্যান্য আরবি পাণ্ডুলিপির সঙ্গে জার্মানিতে গিয়ে পৌঁছে।
২০১৪ সালের নভেম্বরে তুবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয় এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়, তারা পাণ্ডুলিপির তিনটি পাতা নিয়ে গবেষণা করে নিশ্চিত হয়েছেন, এটি হিজরি প্রথম শতকে, নবীজি (সা.)-এর ইন্তেকালের ২০ থেকে ৪০ বছর সময়ের মধ্যেই লেখা হয়েছিল। কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে তুবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয় ৯৫.৪ শতাংশ নিশ্চয়তা দিয়ে দাবি করেছে, এটি লেখা হয়েছিল ৬৪৯ থেকে ৬৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। অর্থাৎ হজরত উসমান (রা.) কিংবা হজরত আলী (রা.)-এর খেলাফতকালে।
তুবিনজেন ফ্র্যাগমেন্টে ১৭ নম্বর সূরার (আল-ইসরা) ৩৬ নম্বর আয়াত থেকে ৩৬ নম্বর সূরার (ইয়াসিন) ৫৭ নম্বর আয়াত পর্যন্ত লিপিবদ্ধ আছে; যা সম্পূর্ণ কোরআনের প্রায় ২৬.২ শতাংশ। পশুর চামড়া থেকে প্রস্তুতকৃত পৃষ্ঠাগুলোর প্রতিটির আকার দৈর্ঘ্যে ১৯.৫ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থে ১৫.৩ সেন্টিমিটার, এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় গড়ে ১৮ থেকে ২১টি করে লাইন আছে।
সাজেদ/