প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২, ২০২২, ১২:১০ এএম
খাবারের ক্ষেত্রে বাঙালি খুবই বৈচিত্র্যময়। অঞ্চলভেদে বাঙালিদের রয়েছে বিভিন্ন খাবারের জনপ্রিয়তা। বাঙালি যেমন খেতে পছন্দ করে তেমনি খাওয়াতেও ভালোবাসে। অতিথিপরায়ণতায় বাঙালিদের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে।
চট্টগ্রামের বড় ধরণের খাবারের আয়োজনকে বলে মেজবান। আর সেই আয়োজনে মাংসে রয়েছে আলাদা ধরণের রন্ধন রীতি। তাকে বলা হয় মেজবানির মাংস।সাধারণত দুইটি কারনে চট্টগ্রামে মেজবান হয়। একটি সুখ, মানে খুশি। যেমন- কারো বিয়ে, জন্মদিন, ব্যবসায় উন্নতি, নতুন ব্যবসা, আকিকা ইত্যাদি। আরেকটি শোক, মানে অনুতাপ। যেমন কারো মৃত্যুর পর কুলখানি, চেহলাম, মৃত্যুবার্ষিকী, যাতে থাকে সম্পূর্ণ ছওয়াবের উদ্দেশ্য। এছাড়া নির্দিষ্ট উপলক্ষ ছাড়া বা কোনো শুভ ঘটনার জন্যও মেজবান করা হয়। তবে ৮০ দশকের পর থেকে রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এ মেজবান।
শতবর্ষের পরিক্রমায় মেজবান শব্দটার অর্থে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে মেজবান মানে হচ্ছে, বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আপ্যায়নের ব্যবস্থা। অর্থাৎ সামর্থ যা-ই থাকুক না কেন, ধনী-গরীব যে-ই মেজবানের আয়োজন করবে তার অতিথির সংখ্যা নিরূপণ করা চলবে না। অর্থাৎ অতিথির সংখ্যা গুনে মেজবানের আয়োজন সম্ভব নয়। যত অতিথি আসবে এবং যে পরিমাণ খেতে চাইবে ততটুকু পরিবেশন করাই হলো পরিপূর্ণ মেজবানের বৈশিষ্ট্য।
মেজবানির দাওয়াত সবার জন্য উন্মুক্ত। গ্রামাঞ্চলে কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তি মেজবানির আয়োজন করলে লোকের মাধ্যমে সেই ভোজের দাওয়াত বিভিন্ন গ্রাম ও পাড়া মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে আগে ঢোল পিটিয়ে মেজবানের দাওয়াত দেয়ার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল।
এর আগে আত্মীয়, পাড়া-পড়শী, বন্ধুবান্ধব ও গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য মেজবানের আয়োজন হত। বর্তমানের মেজবান অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক চিত্ত আর গাড়িওয়ালা বিত্তবানদের পদচারণা বেশি। গরিব-দু:খি মানুষের সেখানে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
গরুর মাংসের জন্য আদিকাল থেকেই চট্টগ্রাম প্রসিদ্ধ। এখানকার লাল গরু (রেড ক্যাটল অব চিটাগাং) সবচেয়ে উন্নত দেশী গরুর জাত। মূলত চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, চন্দনাইশসহ সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলেএগরু উৎপাদন হয় বেশি। দেখতে সুন্দর এ গরু আকারে ছোট হলেও মাংস সুস্বাদু, পুষ্টিকর। মেজবানে মূলত লাল গরুর ব্যবহারই সবচেয়ে বেশি।
মেজবানের মূল খাবারের তালিকায় থাকে গরুর মাংস ও সাদা ভাত। সঙ্গে ছোলার ডাল, গরুর হাড় দিয়ে ঝোল রান্না। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিয়ে কিংবা যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিবেশিত খাবার সাধারণত একবারের বেশি দেয়া না হলেও মেজবানে অতিথির চাহিদা অনুযায়ী খাবার পরিবেশন করা হয়। অর্থাৎ ইচ্ছেমতো মাংস কিংবা আহার গ্রহণ।
মেজবানি মাংস রয়েছে আলাদা বিশেষত্ব। বেশকিছু কৌশল। এই রান্নার আসল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে প্রচুর পরিমাণ মসলা দেওয়া হয়। ঝালও থাকে অনেক। বিশেষ কায়দায়এ অঞ্চলের বাবুর্চিরা সাধারণতগরুর মাংস দিয়ে মেজবানির মাংস রান্না করেন। মূল পদ গরুর মাংস হলেও এই মাংস রান্নার ধরন আলাদা। মসলাও ভিন্ন। মেজবানি রান্নার আগে বিশেষ মসলার মিশ্রণ তৈরি করে নিতে হবে। অবশ্যই এই রান্না করতে হবে সরিষার তেলে। শুধু তা-ই নয়, রান্নার ডেকচি থেকে শুরু করে চুলা পর্যন্ত আলাদা। এই কাজে দক্ষ চট্টগ্রামের বাবুর্চিরাও। বংশ পরম্পরায় তাঁরা এই ঐতিহ্যের ধারা অব্যাহত রেখেছেন।তবেই পাওয়া যাবে আসল মেজবানি মাংসের স্বাদ।
দেশী-বিদেশী মসলার পাশাপাশি স্থানীয় হাটহাজারী অঞ্চলের বিশেষ ধরনের শুকনা লাল মরিচ ব্যবহারের ফলে মাংসের স্বাদ অতুলনীয় যেকোনো ভোজনরসিকের কাছে। শুকনা এ মরিচে ঝাল কম। দাম অন্যান্য মরিচের চেয়ে বেশি। মেজবান অনুষ্ঠানে এর চাহিদাই দামে হেরফেরের মূল কারণ।
সাজেদ/