প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২২, ০৬:০০ পিএম
কই গো বৌমা । আমার প্রেসারের ঔষুধটা দাও। দেরি হয়ে যাচ্ছে। এই সব ওষুধ সঠিক সময়ে না খেলে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। সকাল বেলায় বসার ঘরে যেখানে সবাই বসে চা খাচ্ছে, সেখানে সোফায় বসতে বসতে আরতি দেবী কথাগুলো বললেন তার বড় বৌমা মধুকে।
মধু এ বাড়ির বড় বৌ। বড় ঘরের মেয়ে। কোনো রকম বিরক্ত তার কোষ্ঠীতে লেখা নেই। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। শিক্ষিত, চাকরি করতো, কিন্তু সংসারের জন্য সেটা ছেড়ে দেয়।
---- দিচ্ছি মা। রান্না ঘর থেকে জানান দেয় মধু।
মধু এ বাড়ির বড় বৌ। বাড়িতে মধুর শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী, দেবর, ননদ আছে তার বিয়ে হয়ে গেছে। আর আছে মধুর একটি মেয়ে। এই নিয়ে মধুর সংসার। এ বাড়ির সবাই খুব punctual.
সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও তাই। আবার খুঁতখুঁতে। পোশাক-আশাকের ব্যাপারে তো কথাই নেই। মোটামুটি পান থেকে চুন খসলেই বাড়ি মাথায় তুলে দেবে সবাই। বিশেষ করে মধুর স্বামী তপু।
আমি স্নান করতে যাচ্ছি, আমার অফিস যাবার পোশাকগুলো রেডি করে রাখো। ও, হ্যাঁ, আমার নীল শার্টটা আজ বার করে দেবে। ওটা আজ পরে যাবো। বাথরুমে যেতে যেতে মধুর স্বামী তপেন ওরফে তপু বলে মধুকে।
মধু রান্না ঘর থেকে বলল, ওটা ইস্ত্রি করা হয়নি। আজ অন্য একটা পরে যাও।
হয়নি মানে? সারা দিন কি করো? সামান্য ইস্ত্রি টুকুও করে রাখতে পারো না? যত্ত সব। দয়া করে হাতের কাজটা রেখে আগে আমার নীল শার্টটা ইস্ত্রি করে দাও।
মধু রান্না ঘরে সবজি কাটতে কাটতে বলে, আজ অন্য একটা শার্ট পরে যাও। এখন ইস্ত্রি করার সময় হবে না। তোমার অফিসের ভাত, তোমার টিফিন। ভাইয়ের আলাদা টিফিন। বাবা-মায়ের আলাদা রান্না, টিফিন। তোমার মেয়ের টিফিন, এতগুলো করবো কখন বলতো? আজ একটু দেরি হয়ে গেছে উঠতে।
এক ঘণ্টা আগে উঠতে পারো না? তাহলে তো সব কাজ সময় মতো হয়ে যেত।
প্রতিদিন ভোর সাড়ে চারটের সময় উঠি। এর থেকে আর কত তাড়াতাড়ি উঠবো বলতো? রাতে ঘুমোতে যেতেও রাত দেড়টা হয়ে যায়। এখন আবার কাজের মাসিও আসছে না। একা হাতে সব কিছু করতে হয়।
একা হাতে মানে? কি বলতে চাইছো তুমি? আমার মা তোমার সঙ্গে এই বয়সে কাজ করবে? এটাই বলতে চাইছো? বাথরুমে ঢোকার আগে মধুকে শুনিয়ে গেল কথাগুলো।
সব সময় উল্টো মানে কেন করো বলতো? বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয় মধু। যাও স্নানে যাও, আর কথা বাড়াতে হবে না। আমি করে দিচ্ছি। তুমি স্নানে যাও। তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মা আমার ম্যাথসের বইটা খুঁজে পাচ্ছি না। চুমকি চেঁচিয়ে মায়ের কাছে জানতে চাইল। চুমকি মধু ও তপুর একমাত্র মেয়ে। ক্লাস ফোরে পড়ে।
ভাচভফ করে খুঁজে দেখো, টেবিলের উপরেই আছে। কাল অংক করার পর তো ওখানেই
রেখেছো।
----- বৌমা আমার খাবার আগের ওষুধ টা দাও।
খাবার ১০ মিনিট আগে ওটা খেতে হয়।
--- হ্যাঁ বাবা দিচ্ছি। এই বলে মধু চলে গেল শ্বশুরের জন্য ওষুধ আনতে। ওষুধ এনে শ্বশুরের হাতে দিয়ে, এক গ্লাস জল দিয়ে বলে, এই নিন বাবা আপনার ওষুধ ।
মধু তাড়াতাড়ি করে স্বামীর নীল শার্ট ইস্ত্রি করতে গিয়ে মনে পড়ল ডাল বসিয়েছে। তাড়াতাড়ি করে যখন রান্না ঘরে যায়, গিয়ে দেখে ডালটা একটু লেগে
গেছে। তাড়াতাড়ি করে ডালটা নামাতে গিয়ে হাতে পড়ে যায় ডালটা। মাগো! বলে চিৎকার করে ওঠে মধু। সবাই কি হলো? কি হলো? দূর থেকে জিজ্ঞেস করছে, কিন্তু কাছে এসে কেউ দেখছে না। শাশুড়ির এমন কোনো বয়স হয়ে যায়নি যে, তিনি উঠে এসে দেখতে পারতেন না। শ্বশুর মশাইও তাই।
শেষে মধুর দেবর ছুটে আসে। মধুকে মধুদি বলে ডাকে তার দেবর। মধুরও ছোট ভাই নেই। সে তাকে ভাই বলে ডাকে।
কি হলো মধুদি! আরে! হাতটা তো লাল হয়ে গেছে। দাঁড়াও আমি ওষুধ নিয়ে আসছি। দেবর ওষুধ এনে লাগিয়ে দেয়। লাগাতে লাগাতে বলে, " তোমাকে আর এখন কিছু করতে হবে না। বাকিগুলো আমি করে দিচ্ছি।"
তা বললে কি হয় ভাই! আমার কাজ আমাকেই করতে হবে। তাড়াতাড়ি লাগাও ভাই। আমার নতুন করে ডাল বসাতে হবে। সব ডালটা তো পড়ে গেল। তোমার দাদা আবার ডাল ছাড়া খেতে পারে না।
যেটা আছে দাদাকে দিয়ে দাও, আমি ডাল খাবো না। তবু তুমি আর ডাল করতে যাবে না।
মাছের ঝোল করেছো তো। ওটা দিয়েই হবে। তার সঙ্গে আরও কিছু তো আছে। আর নয়, এবার হাতটাকে একটু বিশ্রাম দাও। কি করে পারো মধুদি? মুখ বুজে সহ্য করতে। সারাদিন খাটতে। মেসিন তো নও, মানুষ তো।
তোমার দাদার শার্টটা ইস্ত্রি করা শেষ হয়নি
ওটা করে দিই।
---- আমি করে দিচ্ছি। এই বলে দীপু দাদার শার্টটা ইস্ত্রি করতে গেল। ঠিক ঐ সময় তপু অর্থাৎ মধুর স্বামী স্নান করে বেরোচ্ছে। ভাইকে ইস্ত্রি করতে দেখে বলে, "তুই কেন?" তোর মধুদি কোথায় গেল?
মধুদির হাত পুড়ে গেছে। তাই আমি করছি।
হাত পুড়ে গেছে? কি করে পুড়লো? নবাবের নাতনি; কাজকর্ম করা কী অভ্যাস আছে। সামান্য একটু কাজ, তাতেই হাত পুড়ে গেল। তা, তিনি এখন কোথায়? এই কথা বলে তপু ঘরের ভিতরে গেল।
কোথায় আবার। ঐ রান্না ঘরে। হাত কেন, সারা অঙ্গ পুড়ে গেলেও তাকে রান্না ঘরেই থাকতে হবে।
ভালো বংশের মেয়ে পেয়েছিস দাদা। অন্য মেয়ে হলে এই সংসার ছেড়ে পালিয়ে যেত। একটু ভালো ব্যবহার করতে পারিস না? এর জন্য তো টাকা লাগে না। একটু মিষ্টি ব্যবহার কর। দাদাকে কিছু কথা শুনিয়ে দেয় দীপু।
মা --- ভাত দাও। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
চলে এসো বাড়া হয়ে গেছে। মধু মাছের কাঁটা বেছে দিয়ে চলে গেল আবার রান্না ঘরে।
বৌমা আমাকে আজ দুটো রুটি করে দেবে।
তোমাদের ঐ কি সব জলখাবার আমি খাবো না
আজ।
আচ্ছা মা ঠিক আছে। মা একটু অপেক্ষা করুন। আটা মাখা নেই তো। মেখেই আমি রুটি করে দিচ্ছি।
---- আটা একটু মেখে রাখতে পারো না? পোশাক পরে, চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে তপু। জানো তো, মা সব দিন একই খাবার খেতে পারেন না। সেই টুকু কাজ করতেও কি তোমার কষ্ট হয়?
কেন রে দাদা। মা তো একটু তোর বৌকে সাহায্য করতে পারে। মায়ের এমন কোনো বয়স হয়নি যে, অল্প স্বল্প কাজ করতে পারবে না। মেয়ের বাড়ি গেলে
সেখানে জামাইকে চা করে দিতে আমি দেখেছি। আর এখানে পারবে না। আসলে ঘোড়া দেখলে কিছু মানুষ খোড়া হয়ে যায়।
কি বললি? মা এই বয়সে এসে কাজ করবে? তাহলে ছেলে মানুষ করে তার বিয়ে দিয়ে বৌ আনলো কেন?
----- বৌ নয়; বল ঝি এনেছে। আমার বৌকে এই রকম করলে, মজা দেখিয়ে দিতাম। দীপু বিরক্ত হয়ে বললো কথাগুলো।
----- তবে আর কি বৌকে শোকেসে সাজিয়ে রাখবি।
---- ভাই, তুমি চুমকিকে একটু স্কুল বাসে দিয়ে আসবে? মধু দীপুকে বলে।
---- অবশ্যই। তৈরি করে দাও।
মধু চুমকিকে তৈরি করে দিলো। চুমকি কাকুর সঙ্গে বেরিয়ে গেল।
------- চল চুমকি। অনেক দেরি হয়ে গেল। আমাকে আবার অফিসে যেতে হবে।
----- হ্যারে তপু, বাজারে তাল উঠেনি? যদি দেখতে পাস তাহলে দুটো আনবি তো? তোর বোন আবার তালের পিঠে খেতে খুব ভালোবাসে। বৌমা একটু আতপ চাল ভিজিয়ে রাখবে? বুঝেছো? কথাটা তপুর কানে পৌঁছাতেই তপু বলে ওঠে, এতে বোঝার কি আছে? তাল আনতে যখন বলেছো তখন চাল যে ভেজাতে হবে, সেটা পাঁচ বছরের বাচ্চাও বোঝে। মায়ের কথার সমর্থনে তপু বলে।
---- মা , বলছিলাম যে , কয়েক দিন পর হলে হয় না । হাতটা পুড়ে গেছে , ভীষণ জ্বালা করছে। মধু পোড়া জায়গায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে। বলতে বলতে মধুর চোখ দিয়ে জল পড়ে যায়। কারও দেখার সময় হয় না।
---- জ্বালা করছে বলে দুটো পিঠে করতে পারবে না?
হাতটা তো অকেজো হয়ে যায়নি? আসলে আমার বোনকে পাঠানো হবে তো, তাই তোমার না করার বাহানা। তপু খেতে খেতে বলে। ডালটা ভাতে মাখিয়ে যেই মুখে পুরেছে, ভুরু কুঁচকে বলে, ডালটা আজ এই রকম গন্ধ করছে কেন? কাজে মন না থাকলে এই রকমই হয়। করতে পারবে না বলে দিলেই তো পারো? আমি হোটেলে খেয়ে নিতাম। সারা দিনের কাজ বলতে তো দুটো রান্না করা। তাও মন দিয়ে করতে পারো না। যত বাহানা।
----- মধু পোড়া হাতটার তাকিয়ে বলল, বাহানা করলে তো, সব কাজেই বাহানা করতে পারতাম। আজ পর্যন্ত আমাকে কোনো কাজে" না" বলতে শুনেছো?
একটু সম্মান দিয়ে কথা বলো তপু। তোমাকে দেখে তোমার মেয়ে কি শিখবে বলতো? সেও তো তাহলে তার মাকে কখনও সম্মান দেবে না।
---- দীপু হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বললো, মধুদি তোমার বাপের বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। তোমাকে পায়নি বলে আমাকে করেছেন। তোমার বাবা খুব অসুস্থ।
---- কি বললে! বাবা অসুস্থ! কি হয়েছে! বাবা এখন কোথায়?
---- নার্সিংহোমে ভর্তি আছেন।
----- তুমি একটু দাঁড়াও। আমি যাবো। তুমি আমাকে পৌঁছে দিতে পারবে?
--- আমি তোমার সঙ্গে যাবো মধুদি। তোমাকে একা ছাড়তে পারবো না। তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।
এই কথা বলে দীপুও চলে গেল নিজের ঘরে তৈরি হতে।
তপু খেতে খেতে সব কথাগুলো শুনছিল। এতক্ষণ পর্যন্ত কিছু বলেনি। দীপু ঘরে চলে যেতেই তপু বলে
---- তুমি এখনই চলে যাবে? কোনো প্রস্তুতি নেই। হঠাৎ করে চলে যাবো বললেই হলো? সংসারের কাজ এতগুলো পড়ে আছে? সেগুলো ফেলে চলে যাবে? তা ছাড়া বাবা-মা এখনও খাননি। চুমকি স্কুলে
আছে। তাকে আনা হয়নি। তা ছাড়া তুমি তো ডাক্তার
নও।তুমি গিয়ে কিই বা করতে পারবে? বয়স হলে মানুষের একটু আধটু শরীর খারাপ হতেই পারে। তার জন্য সংসার ফেলে ছুটে চলে যেতে হবে? হ্যাঁ, যেতে হলে দুদিন পরে যেও।
---- মধু একটা ব্যাগের মধ্যে কিছু জামা কাপড় ঢুকিয়ে
নিলো। তারপর তপুর দিকে তাকিয়ে বলল, বাবাটা আমার। তার ভালো-মন্দ আমাকেই দেখতে হবে। আমি বাবার একমাত্র সন্তান। আমার বাবার জন্য আমার মনটাও কেঁদে ওঠে। যেমন তোমার বাবা-মায়ের জন্য তোমার হয়। আর কি কাজের কথা বলছো; এই টুকু কাজ করতে পারবে না? আজকের রান্না তো আমি করে দিয়েছি। কালকের থেকে তুমি করতে পারবে না?
কিছুই না, শুধু সকালে উঠে আগে বাসি ঘর ঝাঁট দেবে, তারপর চা করবে, মনে রাখবে সবাই একই রকম চা খায় না, কারো দুধ চা, কারো চিনি ছাড়া লিকার, আর তোমার টিফিন, ভাইয়ের টিফিন, তোমার বাবা-মা’র টিফিন, অবশ্য যেটা যেদিন খেতে চাইবেন, চুমকির টিফিন, জল, স্কুল ব্যাগ গুছিয়ে দেওয়া, আর তোমার মায়ের সময় মতো ওষুধ দেওয়া, গরম জল দেওয়া, আর ঘরটা কিন্তু রোজ পরিষ্কার করবে, ভালো করে মুছবে। তপু মধুর কথা শেষ করতে না দিয়েই বলে;
---- এতো সব কাজ আমি কি করে করবো একা হাতে?
--- মধু কাপড়ের কুঁচিটা ঠিক করতে করতে বলে, এত কাজ কোথায়? এতো সামান্য কাজ। এই টুকু করতে পারবে না? আমি তো আজ বছরের পর বছর রান্না করছি। কাজের মাসি আসছে না করোনার জন্য। কাপড়গুলো হাতে কাচতে হবে। বাজার থেকে তাল এনে তোমার বোনকে পিঠে করে পাঠাতে ভুলো না।
ছাদে যে গাছগুলো আছে সেগুলোতে রোজ জল দেবে। ভাই চলো এবার বেরোতে হবে। ও হ্যাঁ, আর একটা কথা, তোমার পোশাকগুলো সময় মতো ইস্ত্রি করে নেবে। কেমন? এবার আমি যাই।
-----তুমি কবে ফিরবে? তপু পিছন থেকে জিজ্ঞেস করে মধুকে।
--- বলতে পারবো না। বাবার অবস্থা দেখি, কি রকম আছেন তিনি।
----- আমার অফিস আছে কিন্তু।
---- হ্যাঁ, অফিস করবে। অসুবিধা কোথায়? প্রতিদিন
ভোর সাড়ে তিনটে বা চারটের সময় উঠবে। তাহলে দেখবে কোনো অসুবিধা হবে না। ঠিক যেভাবে তপু বলতো মধুকে ঠিক সেভাবে মধুও শুনিয়ে দিলো তপুকে। মশারি তুলবে, বিছানা ছাড়বে।
আর এই সামান্য কাজ তুমি ঠিক করতে পারবে আমি জানি।
এই বলে মধু দীপুর সঙ্গে বেরিয়ে গেল। নার্সিংহোমে গিয়ে দেখে বাবাকে, হঠাৎ করে প্রেসার বেড়ে গিয়ে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যান। একটা স্ট্রোক হয়ে যায়। তারপর প্রতিবেশীরাই তাকে নার্সিংহোমে ভর্তি
করেন। এখন একটু সুস্থ আছেন। নার্সিংহোমে
কয়েক দিন থাকার পর তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ দিকে তপুর নাজেহাল অবস্থা। এতো লোকের রান্না, টিফিন, ঘর গোছানো, গাছে জল, সময় মতো বাবা-মায়ের ওষুধ দেওয়া, তার ওপর নিজের অফিস।
কি রে তপু? আজ অফিস যাবি না? তপুর মা হেলে দুলে এসে বসলেন।
--- কি করে যাবো? তোমার বৌমা তো তার বাবাকে দেখতে চলে গেল। আমি অফিস গেলে তোমাদের খেতে দেবে কে? নিজের তো নিয়ে খাবার ক্ষমতা নেই। যদি এই টুকু কাজ করতে, তাহলে আমি নিশ্চিন্তে অফিস যেতে পারতাম।
--- তুই আমাকে এইভাবে কথা শোনাচ্ছিস?
---- কি করবো বলো! আমার পক্ষে তো এই সব কাজ করা সম্ভব নয়। একা হাতে কি করে এত কাজ করি বলতো? তুমি তো একটু করতে পারো? বৌমা থাকলে না হয় না করলে। কিন্তু যখন দেখছো আমি একা, তখন তোমার কি করা উচিৎ নয়? বিরক্ত হয়ে তপু তার মাকে কথাগুলো বলে -- । মনে মনে স্বীকার করে মধু কি করে একা হাতে এতো কাজ সামলায়?
এখন বুঝতে পারছি। মধুর কত কষ্ট হতো।
সংসারের সমস্ত কাজ, কারও কোনো অভাব রাখে না, সময় মতো সব করে দিতো। আমরা ভাবি সংসারের কাজ করার জন্য কোনো বুদ্ধি দরকার হয় না। কিন্তু আমাদের চিন্তা ভাবনাটাই ভুল।
যতটুকু না করলে নয় সেই টুকু করে তপু অফিস চলে গেল। অফিস থেকে মধুকে ফোন করে তপু। ফোন পেয়েই মধু বলে ফোন করার প্রয়োজন নেই, আমি এখন তোমাদের বাড়িতে যেতে পারবো না। আমার বাবা খুব অসুস্থ। আমার মায়ের বয়স
হয়েছে। আমি ছাড়া আমার বাবা-মার আর কেউ
নেই। তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব এখন আমার।
তুমি আর কিছু বলবে? তাহলে রাখছি এখন।
তপু রাগে গরগর করতে বলে, বাপের বাড়ি যাওয়ার পর তোমার মুখে কথা ফুটেছে। এখানে তো এতো মুখ করতে না।
কথাগুলো শুনে মধু কোনো রকম প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বলে এখন রাখছি পরে কথা হবে। বাবাকে ওষুধ খাওয়াতে হবে।
তপু অফিস থেকে সোজা মধুর বাপের বাড়ি।
শ্বশুর, শাশুড়ি ভাবলেন জামাই বুঝি দেখতে এসেছে।
অফিস থেকে ফিরেছে জামাই, তার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে মধুর মা রান্নাঘরে গেলেন।
তপু খাওয়ার পর, মধুকে ডেকে বলল, "বাড়ি চল মধু। খুব অসুবিধা হচ্ছে। তোমাকে ছাড়া ঐ সংসার চলবে না"।
কেন? তুমি তো আছো? মেয়েরা যদি ঘরের কাজ আর বাইরের কাজ একসঙ্গে করতে পারে, তাহলে পুরুষরা কেন পারবে না?
ঐ তো আমাদের পাশের বাড়ির গোস্বামীদার বৌ নেই। আর বিয়েও করেননি। কি সুন্দর মেয়েকে মানুষ করছে, আবার হাট বাজারও করছে, চাকরি তো আছেই। মা, বাবা সবাইকে রান্না করে
খাওয়াচ্ছে। তুমিও চেষ্টা কর, ঠিক পারবে। আর যদি না পারো, তাহলে অন লাইন অর্ডার করে দেবে। আমি এখন যেতে পারবো না। আর চুমকিকে নিয়ে যদি তোমাদের কোনো খাওয়া দাওয়ার অসুবিধে হচ্ছে বলে। আমাকে ভালোবেসে নয়। আমি দু’মাস পরেও যেতে পারি, আবার দু`বছর পরেও যেতে পারি। এখন থেকে আমি কথা দিতে পারছি না। তপু মাথা নীচু করে মধুর কথা গুলো শুনছিল। মধুর মা কথাগুলো শুনতে পেয়েছিলেন।
তিনি এসে মধুকে বললেন, "তুই তপুর সঙ্গে চলে যা। "সেখানে নিশ্চয়ই খুব অসুবিধা হচ্ছে। তোর বাবা এখন অনেকটা সুস্থ। বাকিটা আমি সামলে নেবো।
তা ছাড়া আমার প্রতিবেশীরা খুব ভালো। বিপদে পড়লে সাহায্য করে।
তাহলে আমি কি করতে আছি মা? আমি থাকতে লোককে ডাকবে কেন? তপু মাথা নিচু করে সব শুনে বলে " আমি কি কোনো কাজে আসতে পারি তোমাদের?"
মধু, তুমি আমার বাবা-মার জন্য অনেক করেছো।
তুমি তো করতে বাধ্য ছিলে না, তাও মুখ বুজে সব করেছো । আর আজ তোমার বিপদের সময় আমি যদি কিছু করতে পারি তাহলে কিছুটা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা হবে। এইটুকু আমাকে করতে দাও।
প্লিজ। না হলে , নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।
মধু তপুর কথা শুনে বলে, " কি করতে চাও তুমি"?
তোমার বাবা-মা কে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবো।
ওখানে থেকেই চিকিৎসা করানো হবে তোমার
বাবার। তপু হাতজোড় করে মধু আর মধুর মায়ের কাছে আবেদন করে। আপনি না বলবেন না মা।
আমি তো আপনার ছেলের মতো। বৌমা যদি মেয়ের মতো হতে পারে, জামাই ছেলের মতো হতে পারবে না কেন? আমি দীপুকে এখনি ফোন করে বলে দিচ্ছি
ও সব ব্যবস্থা করে রাখবে। তপু সবাইকে নিয়ে নিজের বাড়িতে গেল। দীপু আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। চুমকি সবাইকে একসঙ্গে পেয়ে আরও খুশি। চুমকি তার বাবার কাছে গিয়ে বলে, বাবা আমি কোথাও চলে গেলে তোমার কষ্ট হবে?
চুমকিকে কোলে নিয়ে তপু বলে, আমি মরে যাবো তাহলে; তোকে এক মূহুর্ত তোকে ছেড়ে থাকতে পারবো না। তোর মায়ের কষ্টটা আগে বুঝিনি।
এবার অনুভব করতে পারছি । আসলে আমরা কেউ অন্যের কষ্টটা বুঝতে চাই না । মধুকে তপু বলে, চুমকি মেয়ে না যদি ছেলে হতো, তাহলে হয়তো আমি
তোমার বাবা-মায়ের কষ্টটা অনুভব করতে পারতাম না। মধু হাসতে হাসতে বলে," দেরিতে হলেও অনুভব
করতে পেরেছো।" এটাই আমার পরম প্রাপ্তি। তবে, বাবা-মা বেশি দিন থাকবে না এখানে। বাবা একটু সুস্থ হলেই মা বাবাকে নিয়ে চলে যাবে।