• ঢাকা রবিবার
    ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

উপকূলীয় এলাকায় প্রয়োজন টেকসই বাঁধ

প্রকাশিত: মে ২৭, ২০২১, ০২:৩৭ পিএম

উপকূলীয় এলাকায় প্রয়োজন টেকসই বাঁধ

সম্পাদকীয়

দৈবক্রমে এবারের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বাংলাদেশে আঘাত হানেনি। তবে এর প্রভাবে বাংলাদেশের ৯টি জেলার ২৮টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে ওইসব এলাকার মানুষের বাড়িঘর ক্ষেতখামার ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
 
ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস নয়, জোয়ারের পানির তোড়েই ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ। যার ফলে জলে গেছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে যে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হতো তা সহজেই অনুমেয়। গণমাধ্যমে খবর এসেছে, ইয়াস ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যায় ভয়াবহ আঘাত হেনেছে। এই আঘাতটি বাংলাদেশে হানলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সিডরের ধ্বংসযজ্ঞকে ছাড়িয়ে যেত।

ম্যান ভার্সেস ন্যাচার। কথাটি খুবই পুরনো। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছে মানব সভ্যতা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে আজ এসেছে তা নয়। এই দুর্যোগ প্রায় প্রতি বছরেই আসে। কোনো কোনো বছরে একাধিকবারও আসে। যেমন ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর এসেছিল ঘূর্ণিঝড় সিডর। এই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ২৬০ থেকে ৩০৫ কিলোমিটার। এতে মারা গিয়েছিল সাড়ে ৩ হাজার মানুষ। ২০০৯ সালের ৫ মে আইলার তাণ্ডবে মারা যায় ১৯৩ জন।

২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেনে মারা যায় ১৭ জন। এর গতিবেগ ছিল ১০০ কিমি। ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানুতে মারা যায় ২৬ জন। ২০১৭ সালের ৩০ মে ঘূর্ণিঝড় মোড়ার আঘাতে মারা যায় ৩ জন। ২০১৯ সালে ফণির হানায় মারা যান ৯ জন। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুলের হানায় মারা যান ২৪ জন। ২০২০ সালের ২০ মে আমফানও বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হেনেছিল। এতে বাতাসের গতিবেগ প্রবল থাকলেও দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া তেমন কোনো প্রাণহানির খবর ছিল না। 

এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে আগে যেমন প্রাণহানি ঘটত এখন তেমন একটা দেখা যায় না। এর প্রধান কারণ হলো প্রযুক্তি দিয়ে প্রকৃতির ধ্বংসযজ্ঞ রুখে দিয়েছে মানুষ। যার প্রমাণ নেদারল্যান্ডসের রটারড্যাম। সেখানে সমুদ্রের পাড় বেঁধে তৈরি করা হয়েছে মহানগর। যার গড় উচ্চতা সমুদ্রের লেভেলের নিচে। এখানেই শেষ নয়, সমুদ্রের মধ্যে গড়া হয়েছে ভাসমান বহুতল বাড়ি। সমুদ্রের ভেতর দিয়ে বানানো হয়েছে টানেল। তাহলে বাংলাদেশ কেন বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে হেরে যাবে? সেই প্রশ্ন আজ সার্বজনীন।
 
তথ্যপ্রযুক্তি, অর্থবিত্তে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম রোল মডেল। বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮। মাথা পিছু আয় ২২২৭ ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার। জাতীয় বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২০-২০২১ সালের বাজেটে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতে বরাদ্দ ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।  নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ তৈরি করেছে পদ্মা সেতু। তাহলে মাত্র ৪৪৫ মাইল উপকূলীয় এলাকাকে কেন টেকসই বাঁধ দিয়ে নিরাপদ করা যাবে না? 

এই কাজটুকু যে টাকার অভাবে করা যাবে না তা তো নয়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নথি থেকে জানা গেছে, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপের এক কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। সেই বাঁধ সংস্কারের জন্য ২০১৫ সালে খরচ করা হয়েছিল ১০০ কোটি টাকা। একই কাজের জন্য ২০১৬ সালে ব্যয় করা হয়েছে ১০৬ কোটি টাকা।

২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে খুলনা বাগেরহাট সাতক্ষীরা জেলার ৫৯৭ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। এসব বাঁধ সংস্কারের জন্য ৩টি প্রকল্প করে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এরপরও জোয়ারের পানি কীভাবে বাঁধ ভেঙে উপকূলীয় ২৮টি উপজেলাকে প্লাবিত করতে পারল এপ্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।  

এই বিষয়টি এখনই খতিয়ে দেখা দরকার। এটা না করলে আগামীর ঘূর্ণিঝড় গোলাপ এসব অঞ্চলে আবারও চালাবে তাণ্ডব। পোকামাকড়ের মতো মারা যাবে মানুষ। তলিয়ে যাবে ক্ষেতখামার ও প্রসিদ্ধ সব জনপদ। এ লজ্জা বা দায় যারই হোক না কেন, খেশারত দিচ্ছে উপকূলের লাখো মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতি। 

ম্যানুয়াল যুগের কথা বাদ। বহু আগেই বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। আগে নির্মাণ কাজের একমাত্র হাতিয়ার ছিল কায়িক শ্রম। এখন সেই স্থান দখল করেছে যন্ত্র। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি হচ্ছে রাস্তাঘাট ব্রিজ কালভার্ট ও দালান কোঠা। 

এবারের ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা করার জন্য দেয়া প্রেস ব্রিফিংয়ে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ড. মো. এনামুর রহমান এমপি বলেছেন, ২০৩১ সালের মধ্যেই এসব অঞ্চলে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এর জন্য ৩৭ বিলিয়ন ডলারের একটা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। আশ্বাসের জন্য এই বাণী চমকপ্রদ হলেও এর বাস্তবায়ন কতটা বাস্তবমুখী হবে তা কেবল অপেক্ষা করে দেখার বিষয় মাত্র। 

তবে আমরা বলতে চাই, প্রযুক্তির ছোয়া নিয়ে হাওড় অঞ্চলে তৈরি করা হয়েছে অল ওয়েদার রোড। সেই প্রযুক্তির দিয়ে কেন আমরা উপকূলে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করতে পারব না? এর জন্য কালক্ষেপণইবা হবে কেন? এর জবাব যাই হোকনা কেন, উপকূলীয় এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণ এখন সময়ের দাবি। 

এবি/এএমকে
আর্কাইভ