মুনওয়ার আলম নির্ঝর
৯০ এর দশকে যাদের জন্ম তাদের কাছে অঞ্জন দত্ত একটা বিস্ময়ের নাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার রঞ্জনা কিংবা বেলাবোস অথবা মেরীতে বুদ হয়ে থাকতাম। একজন জাদুকরের মতো তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন আমাদের কাছে।
অঞ্জন দত্তের এক একটি গান যেন ছিল এক একটি গল্পের মতো। মুগ্ধ হয়ে শুরু থেকে শেষ পুরোটাই শুনতাম। কি ছিল না তার গানে? জমে যাওয়া হোমটাস্ক, ডায়াল করা রং নাম্বার, তিনশো বছরের শহরে প্রেমিকের কাঁধে প্রেমিকার মাথা রাখার একটি জায়গা- সবই ছিল সেখানে।
“রঞ্জনা আমি আর আসবো না, তাই দুপুরবেলাতে ঘুমিও। আসতে হবে না আর বারান্দায়” বলা ছেলেটির না আসার পেছনে তার ভীরুতাই হয়তো ধরা পড়ে, “বুঝবো কী করে তোমার ঐ মেজদাদা শুধু যে তোমার দাদা নয়!” কিন্তু দিনশেষে ঘরে ফিরে এই ছেলেটিই যখন বলে, “সত্যিকারের প্রেম জানি না তো কী তা, যাচ্ছে জমে হোমটাস্ক/ লাগছে না ভালো আর মেট্রো চ্যানেলটাও, কান্না পাচ্ছে সারারাত!” তখন নিজের কৈশোর প্রেম মনে করে কত রঞ্জনা, কত হোমটাস্ক জমানো কান্না পাওয়া ছেলে নিজেকে গুলিয়ে ফেলে গানের সাথে, কে জানে? জানা হয় না তা-ও। রয়ে যায় চিরচেনা গানগুলো, রয়ে যায় অঞ্জন দত্তের গানের প্রতি শ্রোতৃসমাজের আপাদমস্তক মুগ্ধতা।
বাংলা গান এর জগতে অঞ্জন দত্ত একজন জনপ্রিয় শিল্পী। জীবনমুখী গান নামে বাংলা গান এর যে ধারা প্রচলিত, অঞ্জন দত্ত সেই ধারার গান লেখেন, সুর করেন এবং গেয়ে থাকেন। তাঁর গান এর সহজবোধ্যতা সবাইকে আকৃষ্ট করে। তাঁর ছেলেবেলার কথা তাঁর গান এ ভীষণভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান '2441139'।
মুগ্ধতা বাড়তে বাধ্য হয়, যখন গল্পের রচয়িতা নিজেই গল্পে শামিল হন। অঞ্জন দত্তের অভিনয়গুণের প্রকাশও আমরা বেশ কয়েকবার দেখেছি ‘একদিন আচানক’, ‘যুগান্ত’, ‘অন্তরীন’, ‘নির্বাক’, ‘জানি দেখা হবে’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘দেখা’, ‘মিস্টার এন্ড মিসেস আইয়ার’ সহ আরো বেশকিছু সিনেমায়। মৃণাল সেন পরিচালিত ‘চালচিত্র’তে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। এই অভিনয়ের জন্য তিনি ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা নবাগত অভিনেতার পুরষ্কার অর্জন করেন। এছাড়া অঞ্জন দত্ত পরিচালনা করেছেন ‘দ্য বং কানেকশন’, ‘রঞ্জনা আমি আর আসবো না’, ‘চলো…লেট’স গো’, ‘দত্ত ভার্সাস দত্ত’, ‘ম্যাডলি বাঙালি’, ‘শেষ বলে কিছু নেই’, ‘মনবাক্স’ (এখনও মুক্তি পায়নি) সহ ব্যোমকেশ সিরিজের বেশকিছু সিনেমা ।
তার জন্ম ১৯৫৩ সালের ১৯ জানুয়ারি। ‘দার্জিলিংয়ের রাস্তা’ গান গাওয়া অঞ্জন দত্ত বেড়ে উঠেছিলেন দার্জিলিংয়েরই রাস্তায়। সেখানকার পাহাড়ের ধারে সেইন্ট পল’স স্কুলে তার শিক্ষাজীবনের শুরু। শৈশবস্মৃতির প্রতি আবেগমন্থন থেকেই তিনি ‘দার্জিলিংয়ের রাস্তা’ সিনেমাটি নির্মাণ করেন ২০১৩ সালে। তিনি নিজেই বলেন, সিনেমাটি তার গল্প দিয়েই তৈরি।
অঞ্জন দত্ত একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, গায়ক, অভিনেতা, সাংবাদিক। তিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন আর্ট ফিল্মের ধারাতেই, তাই একসময় কাজের অভাবের কারণে তাকে কলকাতাভিত্তিক দৈনিক ‘দ্য স্টেটসম্যান’ এ সাংবাদিকের কাজ নিতে হয়। এতেও অবশ্য তার অভিজ্ঞতার ঝুলি আরো সমৃদ্ধই হয়, তবু বাণিজ্যিক মাত্রার দিকে কোনো আগ্রহ দেখাননি অঞ্জন দত্ত।
তার গান শুনে আমাদের মাথায় ঘুরতো, সত্যিই কি বেলাবোস ফোন তুলেছিল? রঞ্জনা কি বারান্দায় অপেক্ষা করতো ? এসবের উত্তর জানা ছিল না, কিন্তু অঞ্জন দত্ত আর তার গান ছিল আমাদের জন্য। আমাদের সুন্দর সময়কে আরও সুন্দর করার জন্য। এখনও তিনি আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমোহিত করে রাখেন।
অঞ্জন দত্ত থেমে নেই, একে একে যোগ করে চলছেন তার অর্জনের পংক্তিমালা। তিনি আরো এগোবেন। আরো অনেক চরিত্র, অনেক গল্পের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন তার ভক্তকূলকে। আর আমরাও বলতে পারবো, অঞ্জন দা তুমি না থাকলে সকালটা এত মিষ্টি হত না ।
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন