
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০২১, ০৬:০০ পিএম
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘কারাগারের রোজনামচা’। জাতির
পিতা তার এই বইতে কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলকে নিয়ে অন্তত ১৫ জায়গায় স্মৃতিচারণ
করেছেন। ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণার পর ১৯৬৬ সালের ৮ মে দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হন
বঙ্গবন্ধু। এ সময় টানা ৩ বছর ৭ মাসেরও বেশি সময় কারাগারে থাকতে হয় তাকে। এই দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকার
ফলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে শিশু রাসেলও পিতার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন।
ছোট্ট রাসেল মনে করতেন কারাগারটাই তার আব্বার বাড়ি। বাড়িতে পিতা শেখ মুজিবকে না
পেয়ে মা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে ‘আব্বা’ ডাকতেন শিশু রাসেল। এমন হৃদয়গ্রাহী বিষয়ও
উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণে।
কারাগারের
রোজনামচার ২২১ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু ১৯৬৭ সালের ১৪ ও ১৫ এপ্রিলের ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
সেখানে রাসেলকে নিয়ে তিনি লিখেছেন,
“জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম, ছোট ছেলেটা আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে
একটু আশ্চর্য হলাম। আমি যখন রুমের ভেতর যেয়ে ওকে কোলে নিলাম, আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে
কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করলো। ওর মাকে
‘আব্বা’ বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
‘ব্যাপার কী?’ ওর
মা বললো “বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে
ডাকতে।”
শেখ রাসেলকে
নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রথম স্মৃতিচারণ পাওয়া যায় কারাগারের রোজনামচা বইয়ের ৯৩ পৃষ্ঠায়।
এটা ছিল ১৯৬৬ সালের ১৫ জুনের ঘটনা। ওই দিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকা ১৮ মাস
বয়সী রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্মৃতিচারণ করেছেন। সেদিনের সাক্ষাতের প্রসঙ্গ টেনে
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘দূর
থেকে দেখি রাসেল, রেহানা
ও হাচিনা চেয়ে আছে, আমার
রাস্তার দিকে। ১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না, যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম, দূর থেকে পূর্বের মতো ‘আব্বা’ ‘আব্বা’
বলে চিৎকার করছে। একটু পরেই ভেতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিলো। ওরা বললো, আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে
চেয়ে থাকে, বলে
‘আব্বার বাড়ি’। এখন ওর ধারণা হয়েছে— এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি
দিতে হয়।’
১৯৬৬ সালের ৬
জুলাইয়ের বর্ণনায়ও রয়েছে রাসেলের প্রসঙ্গ। বইয়ের ১৪৯ পৃষ্ঠায় স্ত্রীসহ পরিবারের
সদস্যদের সাক্ষাতের কথা বলা হয়েছে। দিনটি ছিল বুধবার। এখানে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘তাড়াতাড়ি
পাঞ্জাবি পরেই হাঁটা দিলাম গেটের দিকে। সেই পুরনো দৃশ্য। রাসেল হাচিনার কোলে। আমাকে
দেখে বলছে, ‘আব্বা!’
আমি যেতেই কোলে এলো। কে কে মেরেছে নালিশ হলো। খরগোস কীভাবে মারা গেছে, কীভাবে দাঁড়াইয়া থাকে দেখালো।’
বইয়ের ১৫৯
পৃষ্ঠায় ১৯৬৬ সালের ১২ জুলাই সাক্ষাৎ শেষে বিদায়ের সময়ের স্মৃতিচারণে রাসেলের
প্রসঙ্গ এসেছে। এখানে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘বিদায় নিয়ে রওয়ানা হলে গেটে দাঁড়াইয়া ওদের
বিদায় দিলাম। গেট পার হলেও রাসেল হাত তুলে আমার কাছে থেকে বিদায় নিলো। বোধ হয় বুঝে
গিয়েছে এটা ওর বাবার বাড়ি, জীবনভর
এখানেই থাকবে!’
‘কারাগারের
রোজনামচা’ বইয়ের ১৮৮ পৃষ্ঠায় ৩ আগস্ট ১৯৬৬ সাল, বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ছোট ছেলেটা আমার
কানে কানে কথা বলে। ২১ মাস বয়স। বললাম, আমার কানে কানে কথা বললে আইবি নারাজ হবে, ভাববে একুশ মাসের ছেলের সঙ্গে রাজনীতি
নিয়ে কানে কানে কথা বলছি। সকলেই হেসে উঠলো। এটা রাসেলের একটা খেলা, কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপ করে থাকে আর
হাসে। আর আমার কাছ থেকে ফিরে যাবার চায় না। ওর মায়ের কাছে দিয়ে ভেতরে চলে আসলাম।’
১৯৬৭ সালের ঈদে
ছেলেমেয়েরা কোনো কেনাকাটা করবে না,
এমন প্রসঙ্গ এনে রাসেলকে নিয়ে ২০১ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু বর্ণনা করেছেন
এভাবে, ‘ওরা
বুঝতে শিখেছে। রাসেল ছোট্ট তাই এখনও বুঝতে শিখে নাই। শরীর ভালো না, কিছুদিন ভুগেছে। দেখা করতে এলে রাসেল
আমাকে মাঝে-মধ্যে ছাড়তে চায় না। ওর কাছ থেকে বিদায় নিতে কষ্ট হয়।’
১৯৬৭ সালের ১৭
মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৪৭তম জন্মবার্ষিকীতে পরিবারের সদস্যরা জেলখানায় সাক্ষাৎ করেন। এ
প্রসঙ্গে বইয়ের ২১০ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “পাঁচটাও বেজে গেলো। ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার
সাহেব বললেন, ‘চলুন, আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলেমেয়েরা
এসেছে।’ তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওয়ানা করলাম জেল গেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই
বৎসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা রাসেলকে পরাইয়া দিলাম, সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিয়ে দিলো।... আওয়ামী লীগ
একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়েছে। রাসেলকে দিয়ে কাটালাম, আমিও হাত দিলাম।”
বইয়ের ২১১
পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রাসেলও
বুঝতে আরম্ভ করেছে, এখন
আর আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।’
১৯৬৭ সালের
২৮-৩০ এপ্রিলের ঘটনাবলির বর্ণনায় রাসেলের প্রসঙ্গ এসেছে। এখানে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,“রাসেল একবার আমার কোলে, একবার তার মার কোলে, একবার টেবিলের ওপরে উঠে বসে। আবার মাঝে
মাঝে আপন মনেই এদিক-ওদিক হাঁটাচলা করে। বড় দুষ্ট হয়েছে, রেহানাকে খুব মারে। রেহানা বললো, ‘আব্বা দেখেন
আমার মুখখানা কী করেছে রাসেল মেরে।’ আমি
ওকে বললাম, তুমি
রেহানাকে মার? রাসেল
বললো, ‘হ্যাঁ
মারি।’ বললাম, ‘না
আব্বা আর মেরো না।’ উত্তর দিলো, ‘মারবো।’ কথা একটাও মুখে রাখে না।’
১৯৬৭ সালের ২৭ ও
২৮ মে’র ঘটনাতেও রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু
বর্ণনা করেছেন। বইয়ের ২৪৬ ও ২৪৭ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ‘‘.. .রাসেল আমাকে পড়ে
শোনালো, আড়াই
বৎসরের ছেলে আমাকে বলছে, ৬
দফা মানতে হবে- সংগ্রাম সংগ্রাম-চলবে চলবে, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, ভাঙা ভাঙা করে বলে কী মিষ্টি শোনায়!
জিজ্ঞাসা করলাম, ও
শিখলো কোথা থেকে? রেণু
বললো, ‘বাসায়
সভা হয়েছে, তখন
কর্মীরা বলেছিল তাই শিখেছে।’ বললাম,
আব্বা, আর
তোমাদের দরকার নাই এ পথের। তোমার আব্বাই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করুন।’’
বইয়ের ২৪০
পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রাসেল
আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে। এক বৎসর হয়ে গেছে জেলে এসেছি। রাসেল একটু বড় হয়ে
গেছে।’
বঙ্গবন্ধুর ১৯৬৭
সালের ২২ জুনের ঘটনা উঠে এসেছে বইয়ের ২৪৯ পৃষ্ঠায়। এখানে তিনি লিখেছেন, “দুই বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা বালি
চলো’। কী উত্তর ওকে আমি দেবো। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি
কারাবন্দি। ওকে বললাম, তোমার
মা’র বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ও কি বুঝতে চায়!
কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা,
ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে!”
বঙ্গবন্ধুর এইসব
স্মৃতিচারণে কঠিন হৃদয়ের মানুষের চোখেও পানি চলে আসে। আজ (১৮ অক্টোবর) জাতির পিতার
সেই আদুরে শেখ রাসেলের ৫৮তম জন্মদিন।
মন্ত্রিপরিষদ
বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ
বছর থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের
জন্মদিন ‘শেখ রাসেল দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট ভাই শেখ রাসেল ১৯৬৪ সালের এ দিনে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক স্মৃতি-বিজড়িত বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানবতার শত্রু ঘৃণ্য ঘাতকদের নির্মম বুলেট থেকে রক্ষা পাননি শিশু শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নরপিশাচরা নির্মমভাবে তাকেও হত্যা করেছিল। তিনি ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।
এস/ডাকুয়া