প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২১, ০৬:৩০ পিএম
শরতের আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। বাতাসের স্রোতে মেঘমালা এসে মিশে যায় মেঘালয়ের পর্বতমালায়। প্রকৃতির এমন অপরূপ লীলায় পাহাড়ের পাদদেশে যদি থাকে নীল জলরাশি, তাহলে দৃশ্যটা কেবল উপভোগ্যই নয়, বরঞ্চ মনোমুগ্ধকর। প্রকৃতির অপরূপ মেলায় নীল জলরাশিতে মিশে এককাপ চা পানের আকাঙ্খা থাকে অনেকের মনে। কিংবা যদি কেউ ভেসে বেড়াতে পারতো ছোট ডিঙ্গিতে করে। মানুষের এমন আক্ষেপ মেটাতেই ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে সেখানে দেখা মিলে রোহাত-রিয়াদদের। বয়স বেশি না বড়জোর ১০-১২ হবে। তবে পর্যটকদের চাহিদা মেটাতে জুড়ি নেই তাদের। ছোট্ট ডিঙ্গিতে করে কেউ বিক্রি করেন চা, চিপস আর শুকনো খাবার। আবার কেউ কেউ ডিঙ্গি ভাসান পর্যটকদের নিয়ে। মনোরঞ্জনে গান গেয়েও শুনান অনেকে। এতে যা কিছু মেলে তাতেই চলে তাদের সংসার।
বলছিলাম ভারতের মেঘালয় পর্বত মালার পাদদেশে অবস্থিত সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওড়ের কিছু ভাসমান শিশুর কথা। দৈনন্দিনের চাহিদা মেটাতেই টাঙুয়ার হাওড়ের ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় দেখা মেলে তাদের। পর্যটকবাহী কেনো নৌকা ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় এসে থামলেই ভিড় করে ভাসমান শিশুর দলটি। ছোট্ট ছোট্ট ডিঙ্গিতে করে নৈাকার পাশে এসেই নানা আবদার তাদের।
তাদেরই একজন রোহাত, পর্যটকবাহী নৌকা থামার পরেই অন্যন্যদের সাথে ভিড় জমায় সেখানে। আবদার করে, ভাইয়া নৌকায় উঠেন, গান শুনামু। আপনার যা খুশি দিয়েন। কথা হয় তার সাথে, বলে তার জীবনের গল্প। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে রোহাত। বাবা জেলে। হাওড় থেকে মাছ ধরে বিক্রি করে যা আয় হয় তাতেই চলে সংসার। কিন্তু স্বল্প আয়ে টানাপোড়া থেকে যায় তাদের পরিবারে। একটু বেশি আয়ের জন্যই টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ৬ মাস নৌকা চালায় সে। প্রতিদিন যা আয় হয় তাতে কিছুটা সাপোর্ট করা হয় পরিবারে।
তাহিরপুর উপজলোর জয়পুর গ্রামে তার বাস। জয়পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সে। হাওড়ে নৌকা চালিয়ে প্রতিদিন ৪শ থেকে ৫ টাকা আয় হয় তার। আর তাতেই বেজায় খুশি রোহাত।
রোহাতের সাথে গল্প করতেই করতেই ছোট্ট কন্ঠে ভেসে আসে মরমি কবি হাছন রাজার জনপ্রিয় গান- ‘কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যেরও মাঝার..... লোকে বলে বলেরে..... ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার’। পিছনে তাকালে দেখা যায়, ডিঙিতে চড়িয়ে দুই পর্যটককে গান শুনাচ্ছে আরেক ভাসমান শিশু রিয়া।
রোহাতের মত সেও জয়পুরের বাসিন্দা। জয়পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে সে। বাবা না থাকায় মাকে সাহায্য করতেই এই প্রায়াশ তার। রোহাতের মতই প্রতিদিন ৪-৫শ টাকা আয় হয় তার। রিয়া প্রতিদিন সকালে আসে এখানে অন্যদের মত না খেয়েই কেটে যায় তার দিন।
রিয়া-রোহাতের সাথে গল্প করতে করতেই ডিঙ্গিতে করে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে হাজির সাব্বির নামক আরেক শিশু। এসেই বাহানা তার- ভাইয়া এটা নেন, পানিতে ভাসতে পারবেন। কিছুটা অপরিপক্ক শুদ্ধ ভাষাতেই কথাগুলো বলে সাব্বির।
৩০ মিনিট ৫০ টাকা ধরে লাইফ জ্যাকেট ভাড়া দেয় সে। এতে করে দিনে ৩-৪শ টাকা আয় হয় তার। সাব্বির জানায়, নৌকাগুলিতে লাইফ জ্যাকেট থাকায় তার আয় কিছুটা কম। তবে কোনো কোনো পর্যটক ৫০ টাকাও বেশি দেয় তাকে।
বড় ভাই রাকিবের কাছ থেকেই সাব্বিরের ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় জ্যাকেট ভাড়া দেয়ার হাতেখড়ি। চাকুরি পেয়ে রাকিব ঢাকায় চলে যাওয়ায় এখন সাব্বিরই প্রতিদিন জয়পুর থেকে হাজির হয় ওয়াচ টওয়ারে।
তাদের সাথে গল্পচলাকালীন সময় রোহাত বলে- ভাইয়া চা খাবেন? চা নিয়ে পানিতে নেমে কতজনে ছবি তুলে।
হাওড়ের মাঝে এককাপ চা, শরীর চাঙ্গা করার জন্য মন্দ নয়। বললাম এখানে চা পাবো কই? রোহাত বলে- দাড়ান ডেকে আনছি। বলেই ডিঙি নিয়ে দৌড় রোহানের। মুহুর্তের মাঝেই আলাদা ডিঙিসহ জোবায়েরকে নিয়ে হাজির সে। জোবায়ের আর রোহাত একসঙ্গেই পড়ে তারা। এ ছাড়া একই গ্রামের বাসিন্দা।
জোবায়ের এখানে চা বিক্রি করে তিন বছর ধরে। সিজনের ৬ মাসই প্রতিদিন সকালে এখানে উপস্থিত হয় সে । তিনটি ফ্লাক্সে করে আনা চা বিক্রিতে কেটে যায় তার সারাদিন। কোনো দিন তিন ফ্লাক্সই বিক্রি হয় তার । আবার কোনো দিন হয় না তা। দিনে গড়ে ৮-৯শ টাকা বিক্রি হয় তার।
টাঙ্গুয়ার হাওড়ের ওয়াচ টাওয়ার প্রতিদিনের আয়ের উৎস হাওড়বাসী কিছু পরিবারের। রোহাত-রিয়া-সাব্বিরদের মত করেই এখানে আরো বেশ কিছু ভাসমান মানুষ রয়েছেন। তাদের মাঝে শিশু ও বয়স্করাও আছেন। হাওড়কে ঘিরেই তাদের বাস। বছরের অর্ধেক সময় পানিতে ডুবে থাকে এই অঞ্চল। বছরের বাকী সময় কৃষিকাজ করলেও এ সময়টায় বেকার থাকতে হয় তাদের। কেউ কেউ জিবিকার তাগিদে তখন মাছ ধরেন। আবার কেউ হাওড় এলাকা পর্যটন কেন্দ্র হওয়ায় সেখানে নিজের পেশা খুঁজে নেন।
তাদেরই একজন জাকির হোসেন। ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় চা, সিগারেট ও শুকনো খাবার বিক্রি করেন তিনি । তিনি বলেন, ‘বছরে ৬মাস পানিতে ডুবে থাকে হাওড়। তখন কিছু করার থাকে না। মাছ ধরতেও পারি না। তাই ওয়াচ টাওয়ারে এসব বিক্রি করে চলি। অন্য সময় কৃষি কাজ করেই পেট চালাই।’
ভাটি অঞ্চলের এই মানুষদের জীবন যেন ভাসমান। অর্ধাহারে অনাহারে কেটে যায় তাদের দিন। সারাদিন না খেয়ে থেকেও ক্লান্তি নেই তাদের চেহারায়। হাসিমুখে বিদায় নিতে নিতে আবারও গানের সুর তোলে রিয়া। এবার তার সাথে যোগ দেয় রোহাত-সাব্বিররাও। তারা এক সূরে গাইতে থাকে -
‘নেশা লাগিলো রে.....বাঁকা দুই নয়োনে নেশা লাগিলো রে..... হাছন রাজা পেয়ারীর প্রেমে মজিলো রে.....নেশা লাগিলো রে......বাঁকা দুই নয়োনে নেশা লাগিলো রে...।
এআরআই