• ঢাকা রবিবার
    ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১

গুপ্তধনের ভাণ্ডার আফগানিস্তান!

প্রকাশিত: আগস্ট ১৯, ২০২১, ১১:৩৮ পিএম

গুপ্তধনের ভাণ্ডার আফগানিস্তান!

শামীম হাসান

যুদ্ধ শেষ। এখন দেশ গড়ার পালা। দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে সে কথাই বলেছেন তালেবান মুখপাত্র। মুখে বললে তো হবে না, দেশ গড়ার জন্য সবার আগে দরকার অর্থ। এ জন্য অবশ্য তালেবানদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। কেননা প্রকৃতি আফগানিস্তানের ব্যাপারে খুবই উদার। 

গুপ্তধনের ভাণ্ডার এই দেশটির মাটির নিচে রাশি রাশি মূল্যবান খনিজ সম্পদ রয়েছে। ১০ বছর আগেই মার্কিন সেনাবাহিনী ও সে দেশের ভূতত্ত্ববিদেরা এ তথ্য জেনেছিলেন। এই ভাণ্ডার দিয়ে এক দশকেই দেশটির অর্থনীতি পাল্টে দেয়া সম্ভব।

ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা কিছু দিন আগে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, আফগানিস্তানে ১ লাখ কোটি ডলার মূল্যের গুপ্তধন রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম খনিজ লিথিয়াম মৌল।

বিশেষজ্ঞরাও বলছেন একই কথা। আফগানিস্তানের মাটির নিচে রয়েছে মূল্যবান সব খনিজ। এসব খনিজ সম্পদ দিয়ে এক দশকেই দেশটির অর্থনীতি পাল্টে দেয়া যায়। দুর্বল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলা সম্ভব। তাহলে মাটির নিচে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রেখে এভাবে দরিদ্র হয়ে থাকার অর্থ কী? এ প্রশ্ন স্বাভাবিক। সমস্যা কোথায়? খনিজ সম্পদ থাকলেই হবে না, তা মাটির ওপরে তুলে আনার জন্য জানা দরকার কলাকৌশল। সে কলাকৌশল ও কাজে লাগানোর বিজ্ঞান তালেবানের আছে কি না সেটাই প্রশ্ন? না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা বিজ্ঞান ও কলাকৌশল উন্নত করার তুলনায় তাদেরকে যুদ্ধ আর টিকে থাকা নিয়েই লড়াই করতে হয়েছে।  



বতমান পৃথিবী দূষণে ভরে যাচ্ছে। সে কারণে দূষণহীন পৃথিবীর জন্য বিশ্বজুড়ে লড়াই চলছে। উন্নত দেশগুলো দূষণহীন যানবাহনের ওপরে জোর দিচ্ছে। এসব যান চলাচলের ব্যাটারি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারির জন্য আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পদার্থের নাম লিথিয়াম। আর এই লিথিয়ামের বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে আফগানিস্তানে। প্রকৃতিতে দুর্লভ এবং‌ খনি থেকে সেই মৌল নিষ্কাশনের পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল বলে যা বহুল ব্যবহারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তানকে আলোয় ফেরাতে পারে মাটির তলায় থাকা এই দুর্লভ গুপ্তধন। তা ছাড়াও রাশি রাশি তামা, সোনা, আকরিক লোহাসহ নানা ধরনের বিরল মৌল রয়েছে বিভিন্ন প্রদেশের মাটির নিচে। এসব গুপ্তধনই ঘুরে দাঁড়ানোর হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের। মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে দেশটির অর্থনীতির।

ইকোলজিক্যাল ফিউচার্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা বিজ্ঞানী ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রড শুনোভার জানিয়েছেন, মাটির তলায় কী পরিমাণ গুপ্তধন রয়েছে আফগানিস্তানে তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের গতিতে রাশ টানতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করে সার্বিকভাবে বৈদ্যুতিক গাড়ি পথে নামাতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন ব্যাটারি রিচার্জ করার জন্য জরুরি লিথিয়াম, তামা, অ্যালুমিনিয়াম ও নিওডিয়াম মৌল। খনিজ লিথিয়াম সবচেয়ে বেশি মজুদ রয়েছে এখন বলিভিয়ায়। আফগানিস্তানের ভাণ্ডার তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। 

শুনোভার আরও বলেন, বিশ্বে লিথিয়াম, কোবাল্ট ও নিকেলের মতো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মৌলগুলোর সরবরাহে যে তিনটি দেশ প্রথমে রয়েছে সেগুলো হলো- চীন, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও অস্ট্রেলিয়া। আফগানিস্তানের খনিজ ভাণ্ডার পাল্লা দিতে পারে তার সঙ্গেও। এই খনিজগুলো ব্যবহার করে এক দশকের মধ্যেই এশিয়ার এই অঞ্চলের ধনীতম দেশ হয়ে উঠতে পারে আফগানিস্তান।



এবার একটু পেছনে ফেরা যাক। ২০ বছর আগে ‘সন্ত্রাস দমন’ কৌশলকে সামনে রেখে ন্যাটো আফগানিস্তানে ঢুকে পড়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের চোখ ছিল দেশটির খনিজ সম্পদে। তাদের মাথায় সহজে তালেবানদের মুছে ফেলার ভাবনা ছিল। ভেবেছিলেন এক ফুৎকারে তালেবানদের মুছে ফেলে দেয়া যাবে, আর আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদও দখল করা যাবে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার ফন্দি ছিল। কিন্তু মাঠপর্যায়ের যুদ্ধ তাদের সেই সুযোগ দেয়নি। তাই তো বর্তমান বাস্তবতায় তালেবানদের সঙ্গে বিরোধিতা নয়, তাদেরকে নিয়েই সেই কাজ করতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র। মাঠ আবার যুক্তরাষ্ট্রকে একা ছেড়ে দিতে চায় অন্যতম দুই শক্তি চীন আর রাশিয়ার। তুরস্কও সেখানে যোগ দিতে চায়।

মূলত আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের বিষয়টি সবার আগে বুঝতে পেরেছিল রাশিয়া। তারা এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়েছিল। তবে তারা প্রকৃত বাস্তবতা ঠিকমতো বুঝতে পারেনি। তাদের অনুসন্ধান যুক্তরাষ্ট্রের কাজটা অনেক সহজ করে দিয়েছিল। আফগানিস্তানে ঢোকার পর ন্যাটোর বিশেষজ্ঞরা দেশটির খনিজ সম্পদ সম্পর্কে ১৯৭০-৮০ সালের দিকে রুশদের করা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো হাত করে নিয়েছিলেন। তার সঙ্গে মিলিয়ে পেন্টাগনের উচ্চ প্রযুক্তিভিত্তিক অনুসন্ধান শেষে গজনিতে লিথিয়ামের বিপুল মজুদের খবর বের হয়।

বিবিসি এক প্রতিবেদনে লিথিয়ামের কারণে আফগানিস্তানকে ‘ভবিষ্যতের সৌদি আরব’ বলেও প্রচার করেছিল। একই রকম বড় লিথিয়াম মজুদ নিয়ে তীব্র ঝামেলা পোহাচ্ছে বলিভিয়ার রাজনীতি। সেখানে ক্ষমতাচ্যুত ইভো মোরলেস তার বিরুদ্ধে সংঘটিত অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের মদদের জন্য লিথিয়ামের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকে কারণ হিসেবে দাবি করেছিলেন। লিথিয়ামের আফগান মজুদ প্রায় বলিভিয়ার সমান। আসন্ন দিনগুলোতে গজনির নিয়ন্ত্রণ তাই অনেকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

চীন মোটেও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে খনিজ পদার্থের বিশাল ভাণ্ডার ছেড়ে দিতে চায় না। অন্য দেশে কিভাবে ঢুকতে হয়, সে কৌশল এখন তারা ভালোভাবেই রপ্ত করেছে। রাষ্ট্রপরিচালকদের হাত করে কীভাবে বড় বড় প্রকল্প নিতে হয়, তৃতীয় বিশ্বে সে বিষয়ে চীনের দক্ষতাই বেশি। ফলে আফগানিস্তানে ঢুকতে তাদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সে প্রমাণ তারা আগেও রেখেছে। আফগানিস্তানে গত ২০ বছর ন্যাটোর শাসন চললেও, চীনের রাষ্ট্রীয় সংস্থা এমসিসি (মেটারোলজিক্যাল করপোরেশন অব চায়না) ৩ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে মেস এয়াংকের সবচেয়ে বড় কপার মজুদ লিজ নিতে পেরেছিল। ২০১৭ সালের ঘটনা এটি। সে সময় সংবাদ বেরিয়ে ছিল খনিজ বিষয়ক মন্ত্রী মোহাম্মদ ইব্রাহিম আদেলকে এমসিসি ৩০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল এ ‘চুক্তি’তে। দুবাইয়ে ওই লেনদেন হয়েছিল। 



কাবুলের ২৫ মাইল দক্ষিণে লগার প্রদেশের বহুল আলোচিত মেস এয়াংক খনিতে প্রায় ৬০ মিলিয়ন মেট্রিক টন কপার মজুদ আছে বলে অনুমান করা হয়। তাড়াহুড়ো করে লিজ নিলেও চীন এখানে উত্তোলন শুরু করতে পারেনি সময়মতো। নিরাপত্তা পরিস্থিতি সুবিধার ছিল না। তা ছাড়া যে বিপুল জনগোষ্ঠী খনি এলাকায় বাড়িঘর হারাবে, তাদের পুনর্বাসন করার বিকল্প কিছু এখনও গড়ে তোলা হয়নি। তবে চীন এই মজুদ কোনোভাবে হাতছাড়া করবে না। বৈশ্বিক কপার চাহিদার অর্ধেক এখন তাদের। তালেবান যে তাই চীনের বন্ধু হয়ে উঠবে, সেটা অস্বাভাবিক নয় মোটেই।

শামীম/সবুজ/এম. জামান
আর্কাইভ