বিনোদন প্রতিবেদক
আশি-নব্বইয়ের দশকে ঢাকাই চলচ্চিত্রে অ্যাকশন সিনেমার জয়জয়কার। নায়ক জসিমের হাত ধরে সিনেমার অ্যাকশনে এসেছিল বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের পালে নতুন হাওয়া এনে দিয়েছিলেন আরেক চিত্রনায়ক, তিনি মাসুম পারভেজ। যাকে সবাই রুবেল নামে চেনেন।
চলচ্চিত্রে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন কুংফু-কারাতের নান্দনিক সব কৌশল নিয়ে। বিশেষত রুবেলের সিনেমাগুলোর প্রতি তরুণ দর্শকদের দারুণ আগ্রহ ছিল। তার সিনেমা হলে এলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ত দর্শক। তিনি রাতারাতি হয়ে উঠেছিলেন সুপারস্টার।
বলা হয়ে থাকে, রুবেলের কোনো সিনেমা ফ্লপ বা ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ ছিল না। বললে অত্যুক্তি হবে না, নায়ক রুবেল ছিলেন ঢাকাই সিনেমার ব্রুসলি। কারণ তার সিনেমাতে ঢাকার দর্শক হলিউডের ব্রুসলির মারামারি উপভোগের বিনোদন পেতেন। যিনি বন্দুক বা কোনো অস্ত্র ছাড়াই শত্রুদের ঘায়েল করতেন।
সেই নায়কের জন্মদিন আজ। ১৯৬২ সালে রুবেল বরিশাল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সময় ২৬ বছর বয়সে বড় ভাই মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানার প্রযোজিত ও গুণী নির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ‘লড়াকু’ সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আগমন করেন। এরপর থেকে তার গল্পটা কেবলই সাফল্যের।
দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রায় ২০০ সিনেমায় অভিনয় করেছেন রুবেল। তিনি কোনো জুটি প্রথায় আবদ্ধ না হয়ে একাধিক নায়িকাকে নিয়ে তিনি সফল সিনেমা উপহার দিয়েছেন। কাঞ্চন-দিতি, কাঞ্চন-চম্পা, মান্না-চম্পা, নাঈম-শাবনাজ জুটি যখন তুমুল জনপ্রিয় তখনও রুবেল নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন নিজস্ব ধারায়। ওমর সানী-সালমানদের যুগেও তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি।
দীর্ঘ দিনের ক্যারিয়ারে রুবেল অভিনয় করেছেন দুই বাংলার প্রায় ৫০ জন নায়িকার সঙ্গে। তার মধ্যে কবিতা ও পপি হচ্ছেন সর্বাধিক ছবির নায়িকা। রুবেলের অন্যান্য নায়িকারা হলেন রানী, জিনাত, শতাব্দী রায় (কলকাতা), সন্ধ্যা, চম্পা, সাথী, মিশেলা, সুচরিতা, পরী, দিতি, একা, মৌসুমী, অরুণা বিশ্বাস, লিমা, নন্দিনী, শিল্পী, তামান্না, সিমলা, কেয়া, সোনিয়া, শাহনাজ, সাহারা, শাহনূর প্রমুখ।
৯০ দশকের একেবারে শেষের দিকে রুবেল নিজে প্রযোজনা ও পরিচালনায় নামেন। তিনি এ পর্যন্ত ১৭টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন যার সবগুলোই ছিল বাম্পার হিট। তার প্রযোজিত ও পরিচালিত সিনেমাগুলো হচ্ছে বিচ্ছু বাহিনী, মায়ের জন্য যুদ্ধ, প্রবেশ নিষেধ, বাঘে বাঘে লড়াই, টর্নেডো কামাল, বিষাক্ত চোখ, রক্ত পিপাসা, সিটি রংবাজ, খুনের পরিণাম, অন্ধকারে চিতা ও চারিদিকে অন্ধকার ইত্যাদি।
রুবেল শুধু একজন অভিনেতাই ছিলেন না সেই শুরু থেকেই তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি ফাইট ডিরেক্টর হিসেবেও সফল ছিলেন। সেই সময়ে বাংলাদেশে মার্শাল আর্টকে জনপ্রিয় করে তোলেন রুবেল। যার ফলে তখন অনেক কিশোর-তরুণ মার্শাল আর্ট শিখতে উৎসাহী হয়।
রুবেল তার বিভিন্ন সিনেমায় মার্শাল আর্ট-এর ভিন্ন ভিন্ন নতুন কলাকৌশল উপস্থাপন করতেন। যার মধ্যে ‘ড্রাংকিং কংফু’ (শত্রু সাবধান), উইপিং কংফু (বাঘের থাবা), ড্যান্সিং কংফু (ভণ্ড), ব্লাইনড কংফু (চারিদিকে শত্রু) সহ দুর্দান্ত সব কলাকৌশল উপস্থাপন করেন।
অনেক ভিলেনকেই রুবেলের সঙ্গে সফল হতে দেখা গেছে। তবে ইলিয়াস কোবরা ছিলেন অনন্য। কারণ এই কোবারও ছিলেন মার্শাল আর্টে পারদর্শী। তার সঙ্গেই বেশি জমে উঠত রুবেলের অ্যাকশন। আর হুমায়ূন ফরীদি ছিলেন রুবেলের সিনেমার কমন ভিলেন। দারুণ একটি জুটি গড়ে উঠেছিল রুবেল-ফরীদির। আর তাদের সেই জুটিকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রয়াত নির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকন।
রুবেল অসংখ্যবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হলেও কখনো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেননি। তবে লাক্স আনন্দ ধারা পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৯৮ সালে। বাচসাস পুরষ্কার পেয়েছেন যথাক্রমে যোদ্ধা (২০০০) এবং বিচ্চু বাহিনী (২০০১) চলচ্চিত্রের জন্য। বর্তমানে রুবেল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এত বর্ণিল সাফল্যের রঙে রঙিন যার ক্যারিয়ার তাকে পুরস্কারের ফিতায় মাপা অনুচিত। বাংলা সিনেমার সোনালি দিনের ইতিহাসে রুবেল চিরদিন থেকে যাবেন উজ্জ্বল এক নক্ষত্র হয়ে, অভিনয় আর নিজেকে উপস্থাপনের স্বকীয়তায়। রুবেল চিরদিন এ দেশের সিনেমার দর্শকের কাছে চমৎকার এক ভালোবাসার নাম হয়ে রইবেন। আরও অনেকদিন বেঁচে থাকুন তিনি আমাদের মাঝে।
রুহুল/এএমকে
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন