প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৪, ০৬:৪১ পিএম
ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একটি ব্যাচের ফলাফলে ভয়াবহ ধস নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে।
২০২২ সালের স্নাতকোত্তর শ্রেণির চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের এমন অভিযোগ করেছেন বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মের পরিপন্থি হলেও ফল প্রকাশিত হওয়ার আগে এ নিয়ে অন্য ব্যাচের কাছে মন্তব্য করেছেন তিনি।
অন্য ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ফলাফল ধস নামিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে।
শিক্ষার্থীদের দাবি, স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় সেমিস্টারে তার দুটি অপশনাল কোর্স থাকলেও কোন শিক্ষার্থী কোর্স দু’টি নিয়ে আগ্রহী হননি। এই ক্ষোভ থেকেই এমন করে থাকতে পারেন বলে ধারণা করছেন তারা।
ভাইভার প্রশ্ন- ‘কুকুরের পাঁচটি জাতের নাম বল’
সংশ্লিষ্ট ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাস্টার্স দ্বিতীয় সেমিস্টারের কোর্সের সমন্বয়ক ছিলেন অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ। ফলে তিনি মাস্টার্সের পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও সমন্বিত কোর্স (কোর্স নং এমসিজে-৫২৭) এর লিখিত পরীক্ষার প্রথম পরীক্ষক ছিলেন। অন্যদিকে একই কোর্সের ভাইভা বোর্ডেও ছিলেন অধ্যাপক নাদির জুনাইদ।
কোর্সটির ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওই কোর্সটিতে ৫৪জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ জনই চার পয়েন্টের স্কেলে ৩ এর নিচে পেয়েছেন। এর মধ্যে ২.৫০ পেয়েছেন ১৪ জন, ২.২৫ পেয়েছেন ১২জন, ২.০০ পেয়েছেন পাঁচজন। এর মধ্যে, স্নাতক পর্যায়ে ফলাফলে প্রথম দশজনের মধ্যে মাস্টার্সে ভর্তি হওয়া ৬ জনের মধ্যে একজনই ২.৭৫ পেয়েছেন। অন্যরা ২.২৫ এর নিচে পেয়েছেন। এ ধরনের গ্রেডস-কে ‘নজীরবিহীন’ বলছেন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
ভাইভায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ভাইভাতে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে পরীক্ষার্থীদের ভীত সন্ত্রস্ত্র করে ফেলতেন অধ্যাপক নাদির। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে জানা প্রশ্নের উত্তরও ভুল হয়ে যাচ্ছিল।
ব্যাচের শিক্ষার্থী শাফাত রহমান ফেসবুকে লেখেন, তিনি ভাইভাতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘ইন্দিরা গান্ধীর সন্তান কতজন?’ আরেক শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কুকুরের ৫টি জাতের নাম বল’। আরেক শিক্ষার্থী বলেন, তিনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, কপিল দেব ১৯৮৩ বিশ্বকাপে যার রেকর্ড ছিল, সেই খেলোয়াড়ের দেশের সঙ্গে পরের বিশ্বকাপে দুইটা রেকর্ড করে। রেকর্ডগুলো কী কী?’-এ ধরনের অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে তিনি অন্য পরীক্ষকদের সামনেও শিক্ষার্থীর ‘ইম্প্রেশন’ খারাপ করে দেন। এরই প্রতিফলন ঘটেছে কম্প্রিহেনসিভের নাম্বারে।
বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমি ভাইভাতে ‘ইয়েস’ বলে তার একটা প্রশ্নের সাড়া দিয়েছিলাম। কেন তাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করিনি- এ নিয়ে অন্তত দশ মিনিট ধরে আমাকে বকাঝকা করেন। ফলে ভাইভার শুরুতেই আমি নার্ভাস হয়ে যাই। সব সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর শেষে তিনি আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন।
তিনি আমাকে এত প্রশ্ন করতে শুরু করেন যে অন্য একজন শিক্ষক তাকে শেষ করার অনুরোধ করেন। এরপর অন্তত ৫-৭টি প্রশ্ন করেন। স্বাভাবিকভাবে সে সময় তিনি এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন যে আমি জানা প্রশ্নের উত্তরও ভুল করছিলাম।
ফল প্রকাশিত হওয়ার আগে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মের পরিপন্থি।
তবে ১২তম ব্যাচের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগে তা নিয়ে ১৩তম ব্যাচের একটি ক্লাসে মন্তব্য করেন। ওই ব্যাচের এক শিক্ষার্থী জানান, কয়েকদিন আগে তিনি আমাদের ক্লাসে ১২ তম ফলাফল নিয়ে কথা বলেন। অথচ সেময় ফলাফল প্রকাশিতই হয়নি।
এ সময় তিনি বলেন, ১২তম ব্যাচের রেজাল্টটা দেখবা কী অবস্থা। আমি ওদের রেজাল্টে ধস নামিয়ে দিয়েছি। কয়েকজন ফেল করতে করতে পাস করে গেছে।
পরীক্ষার ফলাফল প্রভাব পড়তে পারে- এমন আশঙ্কায় ওই শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ করেননি।
মঙ্গলবার একইভাবে ১৬তম ব্যাচের (দ্বিতীয় বর্ষ) ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগেই তিনি ওই ব্যাচের এক শিক্ষার্থীকে তার রেজাল্ট বলে দেন।
একই ব্যাচের অন্য একজন শিক্ষার্থী জানান, আজ বিকাল চারটা নাগাদ আমাদের ব্যাচের ফলাফল নোটিশ বোর্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে টাঙানো হয়। তবে দুপুর দুইটার দিকেই ওই ব্যাচের শিক্ষার্থীকে অধ্যাপক নাদির জুনাইদ বলে দেন। পরে ওই শিক্ষার্থী তার ফলাফল নিয়ে আলোচনা করেন।
শিক্ষার্থীদের ফেসবুক এক্টিভিটি নজরদারি
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অধ্যাপক নাদির জুনাইদ শিক্ষার্থীদের ফেসবুক কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এর ভিত্তিতে তিনি শিক্ষার্থীদের সাথে কেমন আচরণ করবেন, তা নির্ধারণ করেন।
এমনকি ফেসবুক কার্যক্রম দেখে পরীক্ষায় নম্বর দেওয়ার হুমকিও দেন তিনি। সম্প্রতি দ্বিতীয় বর্ষের (১৬তম) শিক্ষার্থীদের এমন হুমকি দেন তিনি।
তার কার্যক্রমে বিরক্ত হয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তাকে নিয়ে পোস্ট করেন। এ নিয়ে সম্প্রতি ১৩ ব্যাচের এক শিক্ষার্থীকে কক্ষে ডেকে নিয়ে বকাঝকা করেন তিনি। বর্তমান শিক্ষার্থী হওয়ায় তিনিও নাম প্রকাশ করতে সাহস পাননি।
১২তম ব্যাচের এক নারী শিক্ষার্থী জানান, ভাইভা বোর্ডে তিনি আমার ফেসবুক কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন করেন। আমি বিভিন্ন সময় মজা করে অনেক পোস্ট করি। এ নিয়ে তিনি আমাকে বিব্রতকর কথা বলতে শুরু করেন। আমি ভাইভাতে কেঁদেও দিয়েছিলাম।
বিভাগের শিক্ষার্থীরা জানান, অধ্যাপক নাদির জুনাইদ যে কোনো কোর্সের ক্লাসেই চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। সংশ্লিষ্ট কোর্স নিয়ে দুই এক মিনিট কথা বলেই চলচ্চিত্রের আলোচনা শুরু করেন। প্রায় প্রতিটি ক্লাসেই একই ধরনের কথা বলেন।
১৩ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের ব্যাচের সার্বিক ফলাফল ভালো। তিনি আমাদের ক্লাশে এসে বলেন, আমি যদি তোমাদের আরও কয়েকটি কোর্স নিতাম, তাহলে দেখতে তোমাদের রেজাল্ট কী হতো!
তিনি বলেন, তোমরা নাকি অনেক মেধাবী। দেখি তোমাদের মেধা কেমন। এমন কথা বলে তিনি বিভিন্ন চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা ও সংলাপের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবে অনেকেই উত্তর দিতে পারে না। এ নিয়ে তিরষ্কার করেন।
সার্বিক বিষয়ে অধ্যাপক ড. নাদির জুনায়েদ বলেন, কম্প্রিহেনসিভ কোর্স আমি নেই না। সারা বছর যা পড়ে সবগুলো কোর্সের ওপরে তাদের কম্প্রিহেনসিভ পরীক্ষা নেওয়া হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে একটা কোর্সে একজন শিক্ষক কীভাবে ফলাফল কমিয়ে দিতে পারে শিক্ষার্থীরা কি এটা বোঝে? পরীক্ষার নাম্বার তো একজন শিক্ষক দেন না। আর ভাইভাতেও তো একজন শিক্ষক থাকেন না।
১২তম ব্যাচের রেজাল্ট প্রকাশ করার এক মাস আগেই নিচের ব্যাচগুলোকে তাদের রেজাল্ট বলে দেন এমন অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, না, এমনটা আমি করিনি। আমি প্রতি ব্যাচকেই বলি তোমাদের কিন্তু রেজাল্ট ভালো হচ্ছে না। আমি প্রতি সপ্তাহেই প্রেজেন্টেশন নিই। প্রেজেন্টেশনের দিনই সন্ধ্যায় আমি রেজাল্ট দিয়ে দিই। আমি তখন বলি দেখ রেজাল্ট, নম্বর কত কমে গেল? এমন হলে তো ভাল রেজাল্ট হবে না। আমি এটাও বলি দেখ, তোমাদের সিনিয়রদের গত বছরও এই কোর্স পড়িয়েছি, তারা নিশ্চয়ই ভুলে গেছে। তারা কিন্তু খারাপ করছে। তোমরা কিন্তু এমন কর না। আসলে তারা বানিয়ে বানিয়ে এসব কথা বলছে। আমিতো বলিনি কে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হয়েছে। এটা দুঃখজনক ও লজ্জাজনক।’
অধ্যাপক নাদির জুনাইদ আরও বলেন, তারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে কেনো? আমি ক্লাশে ওদেরকে অনেক কড়া কড়া কথা বলি, অন্যান্য শিক্ষকদের মতো ঢালাওভাবে নম্বর দেই না, এজন্য অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে।