প্রকাশিত: এপ্রিল ৫, ২০২৩, ১১:১৮ পিএম
ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে সে বিষয়ে কোনো রাষ্ট্র যে নীতি প্রণয়ন করে থাকে সাধারণ অর্থে তাকে শিক্ষানীতি বলে। যুগের নতুন নতুন চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন সময় শিক্ষানীতির পরিবর্তন ঘটানো হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম শিক্ষানীতি প্রণীত হয় ড. কুদরাত-এ-খুদা কর্তৃক ১৯৭২ সালে। আর সরকার বর্তমানে যে শিক্ষানীতিটি বাস্তবায়ন করে চলছে, তা হলো— অধ্যাপক কবীর চৌধুরী প্রণীত “জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০”।
আর শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য যে কয়েকটি উপাদানের কথা বলা হয়ে থাকে তার মধ্যে শিক্ষাক্রম অন্যতম। মার্কিন শিক্ষাবিদ রাফ টাইলারকে শিক্ষাক্রমের জনক বলা হয়। তার মতে, “শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্কুল কর্তৃক পরিকল্পিত ও পরিচালিত শিক্ষার্থীর সব শিখন অভিজ্ঞতা।” “জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০”-এর ২৬নং অধ্যায়েও “ শিক্ষার মূল প্রাণবিন্দু” হিসেবে শিক্ষাক্রমকে উল্লেখ করা হয়েছে।
শিক্ষাক্রমে শিক্ষার স্তরভিত্তিক পরিকল্পনা বিন্যস্ত থাকলেও এটি স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নয়। বরং যুগের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাক্রমের ক্রমাগত নবায়ন ও উন্নয়ন করাটাই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিতও বটে। পেছনের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১৯৯৫-৯৬ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন, উন্নয়ন ও নবায়ন করা হয়েছিল। পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ষষ্ঠ ও নবম শ্রেণিতে ১৯৯৬ এবং সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে ১৯৯৭ আর ১৯৯৮ সাল হতে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা শুরু হয়। তারপর পেরিয়ে যায় দীর্ঘ সময়। বদলে যায় প্রায় গোটা পৃথিবী।
ব্যাপক পরিবর্তন আসে জাতীয় পর্যায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে। অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। তার ফলশ্রুতিতে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকেই “জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২” প্রণয়ন করা হয়েছিলো। ওই শিক্ষাক্রমের আলোকে দেশব্যাপী ২০১৩ শিক্ষাবর্ষ হতে ষষ্ঠ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ২০১৪ সালের মধ্যে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষাক্রম বিস্তরণের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। আর ২০১৫ সালে শুরু হয় একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রম বিস্তরণের কার্যক্রম।
তার পর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের পরিবর্তন আরও গতিশীল হতে থাকে। আর সেই পরিবর্তনের পরিক্রমায় শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন আবারও জরুরি হয়ে পড়ে। বর্তমানের শিক্ষাক্রমের লক্ষণীয় বিষয় হলো— জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ ( এ সময়ে শিক্ষাক্রমের রূপরেখা তৈরি করা হয়), জাতীয় শিক্ষাক্রম বিস্তরণ ২০২২ ( এই শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিক্তিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়) এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ২০২৩ (অর্থাৎ এ সময় থেকে শিক্ষাক্রমটি বাস্তবায়ন শুরু হয়।)
বাস্তবায়নাধীন নতুন এই শিক্ষাক্রমের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈশিষ্ট্য হলো— কাগজকলমে কোনো পরীক্ষা থাকবে না। পড়ানো বা শেখানো নেই। তবে বাস্তব অভিজ্ঞার আলোকে শিক্ষার্থীরা নিজে নিজে শিখে যাবে, কোনো শ্রেণি রোল থাকবে না। প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থান থাকবে না। সবাই সমানভাবে বিবেচিত হবে। শিক্ষক হবেন একজন সহায়তাকারী।
চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় এই শিক্ষাক্রমে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো— শিক্ষার্থী মূল্যায়ন। যা পরিচালিত হবে জাতীয়ভাবে তৈরি অ্যাপসের মাধ্যমে। একজন শিক্ষক একটি বিষয়ের প্রতি সেশন বা অধ্যায় শেষে মূল্যায়ন করবেন এবং শিক্ষার্থীর তথ্য সংরক্ষণ করবেন। মূল্যায়নের জন্য রয়েছে দুটি ব্যবস্থা— ক. শিখনকালীন মূল্যায়ন খ. সামষ্টিক মূল্যায়ন।
শিখন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়ার সময় নিয়মিত ফিডব্যাক প্রদানের মাধ্যমে শিখন সহায়তা করার যে পদ্ধতি সাধারণ অর্থে তাই শিখনকালীন মূল্যায়ন। এর উদ্দেশ্য হলো— শিক্ষার্থীর শিখন পর্যবেক্ষণ, শিখন ঘাটতি চিহ্নিতকরণ ও ঘাটতি পূরণ করে পুরোপুরি যোগ্যতা অর্জন। আর এ কার্যক্রমটি শিখন শেখানো প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শিক্ষা বছরব্যাপী চলমান থাকবে।
অন্যদিকে সামষ্টিক মূল্যায়ন হলো— একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা কতটুকু অর্জিত হয়েছে তা চিহ্নিত করার একটি মূল্যায়ন ব্যবস্থা। আর এই মূল্যায়ন একটি শিক্ষা বছরে মোট দুবার করা হবে। একটি হলো শিক্ষা বছরের মধ্যভাগে, যা সামষ্টিক মূল্যায়ন-১ হিসেবে কল্পনা করা যায়। এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীর অর্জনের মাত্রা যাচাইয়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন তৈরি এবং তার ভিত্তিতে শিখন প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর অন্যটি হলো শিক্ষা বছরের শেষে; যাকে সামিষ্টিক মূল্যায়ন-২ হিসেবে কল্পনা করা যায়। এ মূল্যায়ন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা হলো— কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো একটি যোগ্যতা বা যোগ্যতাসমূহ অর্জনে শিক্ষার্থী কোন পর্যায়ে আছে তা জানা।
আমরা একটু পেছনে তাকালে দেখতে পাব আগের শিক্ষাক্রমে যেখানে অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষা হতো, সেখানে বর্তমান শিক্ষাক্রমে হবে অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন মেলা বা সপ্তাহ এবং বার্ষিক মূল্যায়ন মেলা বা সপ্তাহ। এভাবে শিক্ষা বছর শেষে একজন শিক্ষার্থীর বিভিন্ন যোগ্যতা অর্জন সংক্রান্ত ফল বা রেজাল্ট শীট অনলাইন থেকে প্রিন্ট দিয়ে নিতে হবে।
একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে কোন পদ্ধতিতে বা কোন কোন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করবেন সে জন্য তিনটি ধারা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ধারাগুলো হলো- ক) ধারাবাহিক পারদর্শিতার সূচক (PI-C), সামষ্টিক পারদর্শিতার সূচক (PI-S) , আচরণিক সূচক (BI) ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক বিষয়ের শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক ও সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য একটি মূল্যায়ন ছক তৈরি করবেন। যার মধ্যে কতগুলো সুনির্দিষ্ট কর্মকাণ্ড থাকবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, দলগত কাজে অংশগ্রহণ, দলের দায়িত্ব পালন, একক কাজ, খেলা বা প্রজেক্ট ধরনের কর্মকাণ্ড, আলোচনা ও বিতর্ক, আচরণ ইত্যাদি। আর একজন শিক্ষার্থী নির্ধারিত বিষয়ে কতটুকু শিখতে পেরেছে বা কতটুকু দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে তা মূল্যায়নের জন্য কতগুলো রেটিং মার্ক ব্যবহার করতে পারেন। এগুলোর মধ্যে প্রথম ধাপটি হলো— প্রারম্ভিক (Enacting) ; যাকে এক তারকা (*) বা ইংরেজি E বর্ণ দিয়ে চিহ্নিত করা হবে। এই এক তারকা দেওয়ার মানে হলো— এই চিহ্নের শিক্ষার্থীকে আরও ভালো করতে হবে। তার পর এক তারকা পাওয়া শিক্ষার্থীদের চেয়ে ভালো করা শিক্ষার্থীরা অন্তর্বর্তীকালীন (Provisionally) হিবেসে বিবেচিত হবে। এদের চিহ্নিত করার জন্য দুই তারকা (**) বা ইংরেজি P বর্ণ ব্যবহার করা হবে। অর্থাৎ এ স্তরের শিক্ষার্থীদের গুণগত মান হবে ‘ভালো’ এর পর্যায়ে। আর সর্বশেষ যে স্তরটি রাখা হয়েছে তা হলো দক্ষ (Neat/Expert)। এই স্তরের শিক্ষার্থীদের তিন তরাকা (**) বা ইংরেজি N বর্ণের মাধ্যমে মূল্যায়ন চিহ্ন প্রদান করা হবে। এই রেটিং মার্কের মানে হলো— এ স্তরের শিক্ষার্থীর মান ‘খুব ভালো’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।