• ঢাকা সোমবার
    ১৪ এপ্রিল, ২০২৫, ১ বৈশাখ ১৪৩২

শরীয়তপুরে ৪ দশক ধরে চলছে আধিপত্যের লড়াই, ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে হাতবোমা

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০২৫, ১১:১৭ এএম

শরীয়তপুরে ৪ দশক ধরে চলছে আধিপত্যের লড়াই, ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে হাতবোমা

সিটি নিউজ ডেস্ক

গত ৫ এপ্রিল শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিলাসপুর ইউনিয়নে দুই পক্ষের সংঘর্ষে শতাধিক হাতবোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। গ্রামের বাজারে দাঁড়ানোকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।

এ ঘটনার একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায় একই গ্রামের মানুষ একে অপরের ওপর হাতবোমা নিক্ষেপ করছে। দেখে মনে হবে এ যেন যুদ্ধ চলছে।

এই সংঘর্ষ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিলাসপুরে আধিপত্বের এই লড়াই ৪১ বছর ধরে চলছে। শুধু বোমার আঘাতে এ পর্যন্ত ৮ জনের প্রাণ গেছে। গত বছরের ২৭ মার্চ এমনই এক সংঘর্ষে বোমার আঘাতে ২৫ বছর বয়সী সজিব নামের একজন যুবক মারা যায়।

সজীবের মা জানান, বোমার আঘাতে আহত ছেলের পেট থেকে ৩৭টি তারকাটা বের করা হয়। আর ১১টি তারকাটা সজীবের পেটের মধ্যে রয়ে গিয়েছিল। সাতদিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে মারা যায় সজীব।

এই ঘটনার ১ মাসের মধ্যে আরেকটি সংঘর্ষে স্কুল ছাত্র সৈকত মারা যায়। বোমার আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল সে। পরে হাসপাতালে মারা যায় সে। এদিকে সৈকত মারা যাওয়ার পরও তার বাড়িতেও বোমা হামলা হয়।

প্রতিপক্ষের বোমার আঘাতে এ পর্যন্ত হাজারের ওপর মানুষ আহত হয়েছেন। স্থায়ী অঙ্গহানি, বোমায় উড়ে গেছে হাত বা পা এমন সংখ্যাও শতাধিক। হাত হারানো এক ব্যক্তি বলেন, হাত না থাকায় যাবতীয় কাজকর্ম করতে অনেক কষ্ট হয়।

এখন প্রশ্নটা হলো, তারা কেন নিজেরাই নিজেদের মারছেন? এ নিয়ে অনুসন্ধানে নামে যমুনা নিউজ। তাতে উঠে আসে দুইজনের নাম। এলাকায় তারা বোমা কুদ্দুস আর বোমা জলিল নামে পরিচিত।

এদের মধ্যে কুদ্দুস বিলাসপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি। নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য নিশ্চিত করতে ২০০১ সালে প্রথম বোমাবাজির শুরু করেন তিনি। এলাকায় গড়ে ওঠা চরের জমি দখল নেয়া, পদ্মা নদীর নৌ পথ, বালু তোলা ও মাছ শিকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে।

একই ইস্যুতে এলাকার স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা জলিল মাতবর তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। কুদ্দুসের বিরুদ্ধে নির্বাচনও করেছিলেন তিনি। বছরের পর বছর ধরে চলা তাদের এ যুদ্ধের হাতবোমা অন্যতম হাতিয়ার হয়ে ওঠে। সবশেষ পরিস্থিতি এমন যে, কুদ্দুসের কাছ থেকেই বোমা কিনে তার সাথে যুদ্ধে নামে জলিলের সমর্থকরা।

এ বিষয়ে স্থানীয় একজন বলেন, আক্রমণ ঠেকাতে হলে কিছু একটা তো করতে হবে। সেক্ষেত্রে তাদের কাজ থেকে হাতবোমা সংগ্রহ করতে হয়।

গত ২৪ বছরে অন্তত ৬০ বার এমন সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ। এমনকি একটানা ১৬ দিনও চলেছে এই বোমা নিক্ষেপ।

একজন স্থানীয় একজন, গত ৩৭ বছরে এবারই প্রথম বিলাসপুরের মারামারি একদিনে থেমেছে। আগে একটা ৯ মাস পর্যন্ত মারামারি হয়েছে।

কুদ্দুস আর জলিলের অপরাধের আমলনামা অনেক বিশাল। কুদ্দুসের বিরুদ্ধে ৪৭টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ২৭টি বোমা মেরে মানুষ হত্যা ও হত্যাচেষ্টার মামলা। আর জলিলের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৫০টি। যার মধ্যে ৩৩টি বোমার মামলা। দুইজনই এখন জেলে রয়েছে।

প্রসঙ্গত, ১৯৮৪ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থীতাকে কেন্দ্র করে এই দ্বন্দ্বের শুরু। তারা নিজেরাই বোমা বানিয়ে নিজেদের ওপর মেরে এলাকায় এক ত্রাসের রাজত্ব কেয়েম করেছেন। পুরোটা সময় দুইজন সাবেক সংসদ সদস্য তাদের শেল্টার দিয়ে গেছেন। এলাকার একটি অংশের দাবি জলিল জেলে থাকলে তারা ভালো থাকেন। অপর অংশের দাবি কুদ্দুস জেলে থাকলে তারা ভালো থাকেন।

স্থানীয় একজন বলেন, সাবেক এমপি মোজাম্মেল ভূঁইয়া, ইকবাল হোসেনের ছত্রছায়ায় তারা এই কাজ করেছে। আরেকজন বলেন, এমপি ঝামেলা না মিটে ঝিইয়ে রাখত।

জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেন, মূল অপরাধীরা তৎকালীন সরকারের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। তারা পদেও ছিল। ওই সময় তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে।

এখন প্রশ্ন বোমা বানায় কারা? উত্তর হলো দুইপক্ষের প্রায় সবাই বোমা বানানোর সাথে জড়িত। স্থানীয়দের অনেকেই বোমা বানানোর কৌশল জানে। বহু অনুরোধের পর একজন বোমা বানানোর প্রক্রিয়া দেখাতে রাজি হয়। এ সময় নিমিষেই তিনি বোমা বানিয়ে দেখান।

উপকরণ সব সাথে থাকলে মাত্র ৫ মিনিটিই তৈরি হয় একটি হাতবোমা তৈরি হয়। ১০০ বোমা তৈরি করলে ৪০ হাজার টাকা পারিশ্রমিক অয়ান তারা। নির্জন স্থান, বাগান, পদ্মার চর বা নৌকায় বসেও বোমা বানানো হয়। এমনিকে স্কুলকেও বোমা বানানোর স্পট হিসেবে ব্যাবহার করা হয়।

জানা গেছে, সংঘর্ষের সময় কয়েকজন তাৎক্ষণিকভাবে বোমা বানাতে থাকেন। একজন বলেন, মহিলারা বোমা বানানোর সময় পুলিশ আসে কিনা তা পাহাড়া দেন।

কোথা থেকেই বা আসে বোমার রসদ? কুদ্দুস আর জলিল দুই ক্ষের বক্তব্য রসদের রুট একটিই। একজন বলেন, বোমা কুদ্দুসের ভাই নূর ইসলাম ব্যাপারী প্রতিটি এলাকায় বোমা সরবরাহ করে। আরেকজন বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বোমা তৈরির সরঞ্জাম পিকআপের মাধ্যমে নিয়ে আসে তারা।

এসবের ভয়ে বিলাসপুরের বহু পরিবার নিজ বাড়িতে থাকে না। আহতদের অনেকেই পাল্টা মামলার আসামি হয়ে পলাতক রয়েছে। একজন বাসিন্দা বলেন, সম্ভব হলে বাড়ি বিক্রি করে চলে যাব। এই বিলাপুরে থাকতে চাই না।

এতো বছর প্রশাসন তাহলে কী করেছে? জেলার এসপির কাছে জানতে চায় যমুনা নিউজ।

শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, প্রশাসনের চেষ্টা স্বত্বেও অনেক সময় আইনের ফাঁক ফোকরে অনেকে কারাগার থেকে বের হয়ে যায়। এরপর তারা আবার নাশকতা শুরু করে।

দেশজুড়ে সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ