• ঢাকা সোমবার
    ১০ মার্চ, ২০২৫, ২৬ ফাল্গুন ১৪৩১

ক্ষতিকর জেনেও তামাক আবাদে ঝুকছে কৃষক, হুমকির মুখে কৃষক

প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২৫, ০৬:৩১ পিএম

ক্ষতিকর জেনেও তামাক আবাদে ঝুকছে কৃষক, হুমকির মুখে কৃষক

নীলফামারী প্রতিনিধি

মাটি, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর তামাকের চাষাবাদ। সরকারের পক্ষ থেকে তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হলেও তামাক প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলোর আর্থিক সহযোগিতায় দিন দিন তামাক চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিনা মূল্যে বীজ, ঋণের ওপর সার ও নগদ অর্থসহ জমিতে অন্য ফসলের চেয়ে তামাকের উৎপাদন বেশি হওয়ায় এবং স্থানীয় বাজারগুলোতে তামাকের আশানুরূপ মূল্য পাওয়ায় উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন কৃষকরা। দিন যত বাড়ছে ততই বাড়ছে তামাকের চাষ। এ অবস্থায় চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন এলাকার সাধারণ মানুষ ও কৃষকরা।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, তামাক চাষ ও সেবন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। তামাক পাতা, বিড়ি, সিগারেট, গুল, খইনি ও জর্দাসহ এ ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করায় বাড়ছে ক্যানসারসহ নানা রোগ। তামাক চাষে কৃষকদের পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন সাধারণ মানুষএ।

এছাড়া তামাক কাটার পর রোদে শুকিয়ে অঁটি বেঁধে ঘরে তুলতে হয়। বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত নাড়াচাড়া করতে হয়। এরপর তামাক যায় কোম্পানির গোডাউনে। সেখানেও তামাক পাতা সংরক্ষণ করতে হয়। এতে তামাকের গন্ধ সরাসরি মানবদেহে প্রবেশ করে শিশুসহ নানা বয়সী মানুষ আক্রান্ত হয় নানা রোগে।

ডোমার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ রায়হান বারী বলেন, তামাকজাত দ্রব্য সেবনে বিশেষ করে নাক, গলা ও মুখের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে গলার ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ধূমপানে বিষপান এই কথার কোনও বিকল্প নেই। ধূমপায়ীদের সামাজিকভাবে সচেতন করতে হবে। তাহলে সুফল আসতে পারে।

জানাযায়,১৯৮৪ সাল থেকে ব্রিটিশ আমেরিকা ট্যোবাকো, জাপান ট্যোবাকো, আকিজ ট্যোবাকো, ঢাকা ট্যোবাকো, আবুল খায়ের ও আলফা ট্যোবাকোসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি দীর্ঘদিন যাবৎ এই অঞ্চলে তামাক চাষ ও বিস্তারে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করছে। এসব কোম্পানি চাষিদের তামাক পোড়ানোর সরঞ্জাম সরবরাহ এবং দাদন হিসেবে অগ্রিম টাকা দেওয়ার প্রলোভনে ফেলে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষে নামিয়েছে। কৃষি জমিতে তামাক আবাদের ফলে অন্যান্য আবাদ কমে গেছে। ডোমার উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে সবুজ মাঠের বুক চিরে কীভাবে তামাক চাষাবাদ করা হয়েছে। চোখের দৃষ্টি যতদূর যায়, শুধু ধরা পড়ে তামাক চাষ।

ডোমার উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন কর্মকর্তা মোঃ রফিকুল আলম জানান, উপজেলায়  চলতি মৌসুমে  ২৬৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। তবে কৃষকরা বলছে এবার ব্যাপক হারে তারা তামাকের আবাদ করেছে। সরকারী হিসাবের তিনগুন বেশি জমি তামাকের অাবাদ হয়েছে বলে তারা জানান।
উপজেলার সদর, হরিণচড়া, বোড়াগাড়ী, জোড়াবাড়ি, বামুনিয়া ও সোনারায় ইউনিয়নে  সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ হয়েছে। এমনকি শিশুদেরও দেখা গেছে তামাকের ক্ষেতে কাজ করতে।
হরিনচড়া ইউনিয়নের আটিয়াবাড়ী গ্রামের কৃষক সুমন রায় বলেন, এবার তামাক চাষ করেছি দুই বিঘা জমিতে। গতবার এক বিঘা আবাদেই ৩০ হাজার টাকা লাভ হওয়ায় এবার দুই বিঘা জমিতে তামাকের আবাদ করেছি। তামাক চাষ ক্ষতিকর জেনেও লাভের আশায় চাষ করে থাকি।

একই এলাকার কৃষক লাল বাবু বলেন, প্রতিবছর তামাকের আবাদ করি। লাভও হয় প্রচুর। তামাক তুলে জমিতে ধান লাগাবো। তামাক ক্ষতিকর কিনা জানতে চাইলে বলেন তামাক চাষ ক্ষতিকর না। তিনি বলেন, ক্ষতিকর হলে সরকার আবাদ করতে দেয় কেন। কেউতো এসে বলেনি তামাক আবাদ করা যাবেনা। তিনি আরো বলেন তামাক আবাদ করলে বিক্রি নিয়ে চিন্তা করতে হয়না। কোম্পানি গুলো এসে নিয়ে যায়।

কৃষক কেষ্ট রায় বলেন, প্রতিবছরই তামাক আবাদ করি আমরা। তামাক শরীরের জন্য ক্ষতিকর সেটা আমরা জানি তারপরও কাজ না করে উপায় কি? যেহেতু নিজের জমির আবাদ তাই কাজ তো করতেই হবে।

তিনি আরো বলেন, তামাকের আবাদের পর পরেই কোম্পানিগুলো দাম ঘোষনা করেন।বার্লি জাতের তামাকের রেট ২৮০ টাকা কেজি দরে কিনছে কোম্পানিগুলো। ফলে ফসল তুলার আগেই আমরা দাম জানতে পারি। দাম বেশি পাওয়ায় কাজের উৎসাহ বেড়ে যায়।

কৃষকরা বলেন, ‘বর্তমানে শ্রমিকের অধিক দাম, যে টাকা খরচ করে অন্য ফসল চাষ করি বাজারে সঠিক দাম না থাকায় বিক্রি করে সেই টাকা ওঠে না। অল্প খরচে কোম্পানির টাকায় তামাক চাষ করে অধিক লাভ হয়।’

স্বাস্থ্যের ক্ষতির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যখন তামাকের কাঁচা পাতাগুলো গাঁথি তখন গন্ধে খারাপ লাগে। তবে খুব বেশি ক্ষতি হয়না।

কৃষকরা জানিয়েছেন, তামাক চাষের জন্য উদ্বুদ্ধ করছে ঢাকা টোব্যাকো, আবুল খায়ের টোব্যাকো, নাসির টোব্যাকো, আকিজ টোব্যাকোসহ বেশ কয়েকটি তামাক কোম্পানি। তারা তামাক চাষে অগ্রিম টাকাসহ কৃষকদের সার ও বীজ সরবরাহ করে।

এছাড়াও তামাক কোম্পানির কর্মীরা প্রতিদিন মাঠে গিয়ে চাষির সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কখনও অন্য ফসল উৎপাদনের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ দেখা যায়নি। চাষিদের দাবি-বোরোর মৌসুমে বীজতলা, সবজি ও ফসলের ক্ষেত নষ্ট হলেও কৃষি অফিসের লোকজনকে সংবাদ দিয়েও দেখা পাওয়া যায় না।

তামাকের ডাটা ও পাতা কাটা চাতালে কাজ করেন রনজিৎ রায়। তিনি বলেন, আমি ১০ বছর ধরে চাতালে মেশিনে তামাক পাতা কেটে বিড়ির শুকা বানাই। এতে আমার সামান্য সমস্যা দেখা দিয়েছে।
কৃষক পরিতোষ রায় বলেন, অগ্রাহয়ন মাসে তামাকের পুলি লাগানো হয় ফাল্গুন মাসে তামাক পরিপুর্ন হয়ে যায়। তারপর পাতা কেটে শুকানো হয়। তিন জাতের তামাকের মধ্যে বার্লি ও জাতি তামাকের চাহিদা বেশি। বার্লি তামাক থেকে সিগারেট তৈরি হয়। আর জাতি তামাক দিয়ে হয় জর্দা,গুল ও বিড়ি তৈরি হয়। আর বিলাতি দিয়ে হয় বিভিন্ন প্রকারের জর্দা। আবার বিলাতি তামাকের খরচ কিছুটা কম।
অন্য ফসলের ক্রয়-বিক্রয়ের নিশ্চয়তা এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে তামাক চাষের প্রবণতা অনেকটাই কমে আসবে বলে জানিয়েছেন সাংবাদিক আলমগীর। তিনি বলেন, তামাক চাষের পর এক যোগে মোটা টাকা পাওয়া যায়। তাছাড়া রোগ জীবানু অনেকটাই কম তাই চাষীরা তামাক চাষ ছাড়ছেন না।

স্থানীয় চিকিৎসক তুহিন ইবনে হাদী বলেন, জর্দা, গুল, খইনি ও ধূমপানের ফলে নাক, মুখ, দাঁতের মাড়ির ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে চলে যায়। বিশেষ করে হাঁপানি, অ্যাজমা ও ব্রংকাইটিসসহ নানা ধরনের রোগীরা প্রতিদিনেই হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

ডাঃ তৌহিদ হাসান রাসেল বলেন,ধূমপানে পর্যাপ্ত নিকোটিন মানবদেহে প্রবেশ করে শ্বাসনালীর ক্ষতি করে। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কান, নাক, গলা, মুখ ও ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রফিকুল আলম বলেন, তামাকের দাম ভালো তাছাড়া কোম্পানিগুলোর বিশেষ প্রণোদনার কারনে কৃষকরা তামাক আবাদ করে থাকেন। কৃষি বিভাগ থেকে বার বার নিষেধ করার পরও কৃষকরা তামাক আবাদ করছেন। তামাক জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

দেশজুড়ে সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ