
প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২৫, ০৪:৩২ এএম
রইচ উদ্দিন ও সন্তেষ প্রামানিক ২৭ শতক জমি বিক্রি করেছিলেন ৬৬৩ নম্বর দাগে ফসলি জমি। ক্রেতার বংশধররাও সেই দাগের জমি ভোগ দখল করছিলেন। ৩৮ বছর পর এসে সেই জমি খাজনা খারিজ করতে গিয়ে জানতে পারেন দলিলে দাগ নম্বর ভুলবশত: উঠেছে ৬৭৭ নম্বর দাগ। যা বিক্রেতা রইচ উদ্দিনের বাড়ির জমি।
এখন ক্রেতার বংশধররা জমির মুল্য বেশি হয়ে যাওয়ায় দলিলে থাকা ওই ৬৭৭ নম্বর দাগে বাড়ির জমি দাবি করছেন। এ নিয়ে জমির মালিক রইচ উদ্দিন আদালতে মামলা করে দলিলে দাগ নম্বর সংশোধন করে ডিগ্রিও পেয়েছেন। কিন্তু ক্রেতাপক্ষ না মেনে উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে নানাভাবে হয়রানী করছেন। এখন বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন শতবর্ষী রইচ উদ্দিন ও তার ছেলে আশরাফুল ইসলাম।
ভুক্তভোগী রইচ উদ্দিন পাবনার চাটমোহর উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের জবেরপুর গ্রামের বাসিন্দা। তার ছেলে আশরাফুল ইসলাম হতদরিদ্র রঙ মিস্ত্রি। আর অভিযুক্তরা হলেন, একইগ্রামের বাসিন্দা আমির হোসেন, আব্দুল আলিম ও মনিরুল ইসলাম। তারা জমি ক্রেতা আফসার শেখের নাতী।
জমির দলিল ও কাগজপত্র পর্যালোচনা করে জানা গেছে, রইচ উদ্দিন ও সন্তেষ শেখ ১২/০১/১৯৭৬ তারিখে উথুলী মৌজার ৬৬৩ নম্বর দাগের ২৭ শতক ফসলি জমি বিক্রি করেন একইগ্রামের আফসার শেখ ও আছিয়া বেগমের কাছে। জমি রেজিস্ট্রির সময় তৎকালীন দলিল লেখক ভুলবশত: বিক্রি করা জমির দাগ নম্বর ৬৬৩ এর স্থলে ৬৭৭ নম্বর দাগ উল্লেখ করেন। ক্রেতা বিক্রেতা উভয়য়েই লেখাপাড়া না জানায় বিষয়টি তখন কেউই জানতে পারেননি। ৩৮ বছর ধরে ৬৬৩ নম্বর দাগের ফসলি জমি ভোগদখলের পর ২০১৪ সালে ওই জমি খাজনা খারিজ করতে গিয়ে আফসার শেখ জানতে পারেন দলিলে ৬৬৩ নম্বর দাগের স্থলে দাগ নম্বর ৬৭৭ উল্লেখ আছে। ততদিনে বাড়ির জমির দামও বেড়েছে কয়েকগুণ।
তখন চাটমোহর এসিল্যান্ডের কাছে মিসকেস করেন আফসার শেখ। সেখানে তিনি দাবি করেন, তারা জমি কিনেছেন ৬৭৭ নম্বর দাগে। দলিলেও সেটা উল্লেখ আছে। তাই ওই দাগ নম্বরের কেনা জমি তাদের নামে নামজারী করে দেওয়া হোক। তখন ওই মিসকেসের নোটিশ পেয়ে রইচ উদ্দিনের ছেলে আশরাফুল মিসকেসের বাদিদের বলেন, দলিলে দাগ নম্বর ভুল হয়েছে, তোমরা দলিল সংশোধন করে নাও। আমি করে দিচ্ছি। কারণ আমার বাবা আর ওদের বড় চাচা বেঁচে আছেন। কারণ তারা চাইলেও ৬৭৭ নম্বর দাগে ২৭ শতক জমি তারা পাবে না। এই দাগে জমি মোট ৪১ শতক। তার মধ্যে রইচ উদ্দিনের জমি সোয়া ১৩ শতক। বাকি জমি অন্য ওয়ারিশদের। রইচ উদ্দিনের নামের জমি খাজনা খারিজ করা ৩০/১১/২০০৮ তারিখে। যার হিসাব নম্বর ৭৯৯। নামজারী কেস নম্বর ১৪৯০/০৮-০৯।
রইচ উদ্দিনের ছেলে আশরাফুল ইসলাম বলেন, কিন্তু তারা সেটি না মানায় মিসকেসের নোটিশ নিয়ে চাটমোহর পৌর ভুমি অফিসের তৎকালীন নায়েব কাশেম আলীর কাছে যাই। তার কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি আমার কাগজপত্র না দেখে, আমার কোনো কথা না শুনে তাদের পক্ষে কথা বলেন এবং আমার বাবা রইচ উদ্দিনের নামজারীর খারিজ বাতিল করেন।
এরপর রইচ উদ্দিন ও সন্তেষ প্রামানিক ০২/০১/২০১৪ তারিখে পাবনার আদালতে দলিল সংশোধনের মামলা করেন। স্বাক্ষ্য প্রমাণ শেষে ২৮/১১/২০২৯ তারিখে মামলায় দোতোরফা সূত্রে ডিগ্রি পান তারা। সেই ডিগ্রিতে আদালত আদেশ দেন ‘বিক্রিত তফসিল বর্ণিত ১২/০১/১৯৭৬ তারিখে ১৬৪৬ নম্বর দলিলে ভুল দাগ নম্বর ৬৭৭ কর্তন করে তদস্থলে ৬৬৩ নম্বর দাগ সংশোধন করা হলো। অত্র আদেশের অনুলিপি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিষ্টার বরাবর প্রেরণ করা হলো।’
তারপর ২১/১০/২০২৪ তারিখে সংশোধিত দলিল ও কাগজপত্র নিয়ে এসিল্যান্ড অফিসে গিয়ে মিসকেস করেন রইচ উদ্দিন ও তার ছেলে আশরাফুল ইসলাম। বিবাদী করেন আফসার শেখের নাতী আমির হোসেন, আব্দুল আলিম ও মনিরুল ইসলামকে। মিসকেস করার পর চাটমোহর পৌর ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা মোস্তফা শামীম মিসকেসের সরেজমিন তদন্ত করে এসিল্যান্ডের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন ২৪/০২/২০২৫ তারিখে। সেই প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন ‘উভয়পক্ষের শুনানী ও দলিল যাচাই বাছাই করে ৪৯৯৬/২০১৬-১৭ নম্বর নামজারী বলে খোলা হিসাব নম্বর ১৩৭৮ হতে নালিশী আরএস ৮৬৪ দাগে (যার এসএ দাগ নম্বর ৬৭৭) ০ দশমিক ২৭ একর জমি কর্তন করে মূল খতিয়ানভুক্ত করা যেতে পারে।’
রইচ উদ্দিনের ছেলে আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘গত ২৫ ফেব্রুয়ারি’২০২৫ তারিখে চাটমোহর এসিল্যান্ড অফিসে উভয়পক্ষের শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এস্যিলান্ড সাহেব আমাদের কোনো কাগজপত্র না দেখে বলেন, বিবাদীপক্ষ আদালতে আপীল করেছেন। আমার কিছু করার নেই বলে মিসকেস খারিজ করে দেন।’
আশরাফুল ইসলাম জানান, বিবাদী আমির গং আমাদের দলিল সংশোধনের ডিগ্রির বিরুদ্ধে আদালতে আপীল করেছেন। তারা দলিলে ৬৬৩ নম্বর দাগ না দিয়ে ৬৭৭ নম্বর দাগ দাবি করেছেন। ইতিপূর্বে ২০১৭ সালে মথুরাপুর ইউনিয়নে পরিষদে তিনবার শালিসে বসার জন্য নোটিশ করা হলে আমির হোসেন গং হাজির হন নাই এবং নোটিশেও স্বাক্ষর করেন নাই।’
তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান সরদার মো. আজিজুল হক স্বাক্ষরিত এক প্রত্যায়নপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে ‘৬৭৭ ও ৮৬৪ নম্বর দাগে রইচ উদ্দিনের বসতঘর রয়েছে। ৬৭৭ নম্বর দাগ ভুলক্রমে আফসার শেখের দলিলে উঠে। ৬৬৩ নম্বর দাগের জমি ৬০ শতক আফসার শেখ ভোগদখল করছেন।’
রইচ উদ্দিনের ছেলে আশরাফুল ইসলাম আরো বলেন, ‘আদালত থেকে ডিগ্রি পাওয়ার ইনফরশেন স্লিপ ও ইউপি চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র এসিল্যান্ড স্যারকে দিলেও তিনি গ্রহণ করেননি। তারা আমার কাগজপত্র না দেখে আদালতের আদেশ না মেনে আদালত অবমাননা করেছেন বলে মনে করি। আমি আমার ন্যায়বিচার চাই। কেন সবকিছু আমার পক্ষে তথ্য প্রমাণাদি দলিল কাগজপত্র থাকা স্বত্ত্বেও কেন দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে আমাদের। আমার বাবা একশ’ বছরের উপরে বয়স। তিনিও খুব ভেঙে পড়েছেন, শুধু চোখের পানি ফেলছেন। বিবাদী আমির গং এলাকার প্রভাবশালী, টাকা পয়সা ওয়ালা মানুষ। তারা চ্যালেঞ্জ করেছে যেকোনো মূল্যে ৬৭৭ দাগে আমাদের বাড়ির জমি তারা নিবে। এখন তারা যদি বারবার মামলা করে আমাকে হয়রানী করে সেটা কি প্রশাসন এসিল্যান্ড দেখবেন না?’
শতবর্ষী রইচ উদ্দিন বলেন, ‘আমিতো ৬৭৭ দাগে জমি বিক্রি করি নাই। বিক্রি করছি ৬৬৩ দাগে। সেখানেই তারা ৩৮ বছর ধরে ভোগদখল করে আইসে এহন আমার বাড়ির জমির দাগ দাবি করতিছে। ওই সময় সবাই মুর্খ মানুষ ছিলেম, কেউ লেহাপড়া জানতেম না। মুহুরী ভুল কইরে দলিলে ৬৭৭ নম্বর দাগ তুইলে দিছে। শিডা আবার আমরা আদালত থেকে সংশোধানও করে লিছি। তাহলি কেন তারা মানতিছে না। এতকিছুর পরও কি ন্যায়বিচার পাবো লায়।’
অভিযুক্ত আমির হোসেন বলেন, ‘তারা জাল দলিল করে নিয়ে জমি খারিজ করেছে। তারা সব দাগেই জমি কেনাবেচা করেছে। ২০১৪ সালে আমার দাদা আফসার শেখ যখন আমাদের নামে জমি লিখে দেন তখন জমি খারিজ করতে গিয়ে বিষয়টি জানতে পারি। তাদের ওয়ারিশান জমি নয়, কেনা সম্পত্তি। আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের জন্য শালিসে বসার জন্য তাদের বলা হলেও তারা বসে নাই। আমরা ডিগ্রির বিরুদ্ধে আদালতে আপীল করেছি। এখন আইনের মাধ্যমে যেটা হয় হবে। এখন এ নিয়ে বেশি কথা বলে লাভ নাই।’
এ বিষয়ে চাটমোহর উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মেহেদি হাসান শাকিল বলেন, ‘বাদি বা বিবাদি পক্ষ কেউ যদি আমার রায়ে সন্তুষ্ট না হন, তাহলে তারা আমার রায়ের কপি পাওয়ার পর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এর কাছে আপীল করতে পারবেন। তখন যদি এডিসি স্যার প্রয়োজনে আমার কাছে নথি তলব করেন তখন আমার রায়ের সকল নথি তার কাছে সরবরাহ করবো।’
এসিল্যান্ড আরো বলেন, ‘আর কোনো মামলার বিরুদ্ধে যদি আপীল হয় তাহলে মুল মামলা চলমান থাকে। যদি তাদের (রইচ উদ্দিন গং) মামলার ডিগ্রীর বিরুদ্ধে আপীল করে বিবাদী পক্ষ (আমির গং) তাহলে ওই মামলা এখন চলমান বুঝতে হবে। তাই সেটার রায় না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে। কে ভুল কে সঠিক তা নির্ধারণ করবেন আদালত।’