
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৫, ১০:৪৮ পিএম
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা ঝিনাহদহে তিন জনের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে শুক্রবার রাতে। এই ঘটনায় একটি `চরমপন্থি দল` পরিচয় দাবি করে `দায় স্বীকারের` বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
হত্যার ঘটনাটি ঘটেছে ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর মাঠের শ্মশানঘাট এলাকায়।
স্থানীয় সাংবাদিক ও পুলিশের সাথে কথা বলে জানা যায়, শুক্রবার রাত আটটার দিকে শ্মশানঘাট এলাকায় গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান স্থানীয়রা। পরে খবর পেয়ে রাত ১২টার দিকে শ্মশানঘাট এলাকার একটি খালের পাশ থেকে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তাদের প্রত্যেকের মাথায়ই গুলির চিহ্ন রয়েছে।
এর পরপরই গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে একটি বার্তা আসে যেখানে বলা হয়, `জাসদ গণবাহিনী` নামে একটি সংগঠনের সদস্যদের হাতে এই তিন জন নিহত হয়েছেন।
অতীতে এই নামে একটি সংগঠনের অস্তিত্ব থাকলেও এখন এর সক্রিয়তা আছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
হত্যার ঘটনায় শনিবার রাত পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। শনিবার দুপুরে বিবিসি বাংলাকে এই তথ্য জানিয়েছেন শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুম খান।
স্থানীয়রা বলছেন, সীমান্তবর্তী এই জেলা ও আশপাশের এলাকায় একসময় একাধিক চরমপন্থি দলের দৌরাত্ম্য ছিল। হত্যা-অপহরণের খবর প্রায়ই আসতো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সহিংসতার ঘটনা খুব একটা চোখে পড়েনি। এই ঘটনায় আবার স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক দানা বেঁধে উঠেছে।
নিহতদের পরিচয়
যে তিনজন নিহত হয়েছেন তারা হলেন–– হানিফ আলী, লিটন হোসেন ও রাইসুল ইসলাম।
এই তিনজনের মধ্যে হানিফ আলীর বিষয়ে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, পঞ্চাশোর্ধ এই ব্যক্তি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা ছিলেন।
বাকি দুইজন সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন কিনা–– তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে এটুকু জানা গেছে যে নিহত হানিফ আলীর সঙ্গে তাদের বেশ সখ্য ছিল। লিটন হোসেন ছিলেন হানিফ আলীর শ্যালক। তিনি হানিফ আলীর সাথেই ঘুরে বেড়াতেন।
আর রাইসুল ইসলাম স্নাতকোত্তর শেষ করে এলাকাতেই থাকতেন। তার বাড়ি পার্শ্ববর্তী জেলা কুষ্টিয়ায়।
ঝিনাইদহের স্থানীয় সাংবাদিক বিমল সাহা বিবিসিকে জানিয়েছেন, "নিহত হানিফের নামে অনেক মামলা ছিল। সেইসাথে, হানিফ আওয়ামী লীগের সাথেও জড়িত ছিলেন...মৎস্যজীবী লীগ।"
শৈলকুপা থানার ওসি মাসুম খান বিবিসিকে জানান, "হানিফ পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত। এই হানিফের নামে ১৭টি মামলা আছে, তার মাঝে নয়টিই হলো হত্যা মামলা।"
হত্যাকাণ্ডের শিকার "বাকি দুইজন হানিফের সহযোগী" বলেও উল্লেখ করেন মি. খান।
তিনি আরও বলেন, "বিগত সময়ে বিভিন্ন দল ওকে হায়ার করতো। প্রয়োজন হলে ওকে `মাসল পাওয়ার` হিসেবে ব্যবহার করতো...। গত ১৫ বছরে তো আওয়ামী লীগই ছিল, তারাই করছে।"
এদিকে শুক্রবার রাতেই এই তিনজনকে হত্যার `দায় স্বীকার করে` হোয়াটসঅ্যাপে সাংবাদিকদের কাছে একটি ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। বার্তায় `জাসদ গণবাহিনী` ও `কালু` এই নামগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।
সেখানে লেখা ছিল— "ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনাবাসীর উদ্দেশে জানানো যাচ্ছে, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী কুখ্যাত ডাকাত বাহিনীর শীর্ষ নেতা অসংখ্য খুন, গুম, দখলদারী, ডাকাতি, ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হরিণাকুন্ডুনিবাসী হানিফ তার দুই সহযোগীসহ জাসদ গণবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন।"
সেখানে হুঁশিয়ারি দিয়ে আরও বলা হয়, "এই অঞ্চলের হানিফের সহযোগীদের শুধরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো, অন্যথায় আপনাদের একই পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।"
শৈলকুপা থানার ওসি মি. খান কালুর পরিচয়ের বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, "কালু ইতিপূর্বে বিভিন্ন হত্যা করছে, তার নামে বিভিন্ন অভিযোগ আছে। সে আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোক। সে এখন পলাতক, প্রকাশ্যে দেখা যায় না তাকে।"
"ওর এক ভাই ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছিল। আরেক ভাই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ছিল," যোগ করেন তিনি।
কালুর বাড়ি কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে বলেও তিনি জানান।
কী কারণে খুন
একাধিক স্থানীয় সাংবাদিক, পুলিশ, মানবাধিকারকর্মীর সঙ্গে কথা হয়েছে বিবিসি বাংলার। তাদের সবারই ধারণা, চরমপন্থি দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে।
এ বিষয়ে শৈলকুপা থানার ওসি মাসুম খানের ভাষ্য, "দলের মাঝেই দ্বন্দ্ব ছিল, এখন পর্যন্ত এটাই সামনে এসেছে। তারপরও এটা তদন্তাধীন। তদন্ত হয়ে গেলে আমরা বলতে পারবো।"
স্থানীয় সাংবাদিক বিমল সাহা এলাকার বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, "হানিফের নামে বোধহয় নতুন করে কোনো সংগঠন হচ্ছিলো, সেটিকে প্রতিরোধ করার জন্য হতে পারে। পূর্ব শত্রুতাও পারে।"
আরেক সাংবাদিক নয়ন খন্দকার আবার বলেন, "চরমপন্থি দলের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। তবে অনেকদিন এই ধরনের সহিংসতা ছিল না। দীর্ঘদিন পর আবার এরকম হত্যাকাণ্ড ঘটলো।"
ওই জেলার এক মানবাধিকারকর্মী আমিনুর রহমানের সাথেও এ বিষয়ে কথা হয়।
তিনি বলেন, "হঠাৎ করে গতকাল এটা ঘটেছে। এখানে অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকতে পারে।"
"বিগত অনেক বছর ধরে অনেকে কারাগারে ছিল। সরকার পতনের পর যারা বেরিয়েছে... তাদের হয়তো শত্রুতা ছিল। এগুলো সেই শত্রুতার প্রতিশোধ নেওয়াও হতে পারে।"
শৈলকুপা থানার ওসি এ বিষয়ে খুব সংক্ষেপে বিবিসিকে বলেন, "কিছু কিছু নাম আসছে...দলীয় কোন্দলে যারা আছে... এদের অনেকেই জামিন পেয়ে গেছে।"
গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, নিহতদের প্রত্যেককে শুক্রবার রাতে ফোন করে বাড়ি থেকে ডাকা হয়েছিলো। তবে কারা ডেকেছিলো, কী বলে ডেকেছিলো– সে বিষয়ে এখনও কোনো তথ্য জানা যায়নি।
ঝিনাইদহ জেলা বিএনপি`র সভাপতি এম এ মজিদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বিবিসিকে বলেন, তার মতে এই ঘটনা "চরমপন্থিদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতা এবং এটি আগে থেকেই আছে"।
তবে তিনি মনে করেন, "পুলিশ-প্রশাসনের নজরদারির দুর্বলতার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে।"
এক সময়ের ঝিনাইদহ
এই ঘটনায় যাদের সাথেই কথা বলা হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই বলেছে ঝিনাইদহ ও আশপাশের জেলাগুলোয় একসময় এরকম হত্যাকাণ্ড অহরহ ঘটতো। তবে নিকট অতীতে এরকম ঘটনা বন্ধ ছিল।
আমিনুর রহমানের বর্ণনায়, "অনেকদিন পরে ঘটলো। আগে তো এমনও দিন ছিল প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে চিন্তা করতাম যে আজ কয়জনকে খুন করা হলো! সেগুলো দীর্ঘদিনই নাই। একসময় মনে হতো যে এরাও একটি প্যারালাল সরকার, সেগুলো আর নাই।"
"এক যুগ না, তারও আগে মারাত্মক পরিস্থিতি ছিল। তখন এই এলাকায় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারা, জাসদ গণবাহিনীর আধিপত্য ছিল। একে অপরের সাথে দলীয় কোন্দল ছিল। ব্যক্তির নামেও বিভিন্ন বাহিনী ছিল। সেগুলো এখন বেশি দেখা যায় না," বলছিলেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম "ক্ষমতায় থাকাকালীন অস্ত্র জমা নিয়ে আত্মসমর্পণ করিয়েছিলো। এরপর সরকারি অনেক পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে চরমপন্থিরা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল" বলে মন্তব্য করেন মি. রহমান।
তবে অনেকদিন পরে আবার খুনের ঘটনা ঘটায় ঢালাওভাবে এটি বলা যাবে না যে "চরমপন্থিদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনাও হতে পারে" বলে মনে করেন তিনি।
তার মতে, "শৈলকুপা এলাকা আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে মারামারি, দাঙ্গা, আধিপত্য বিস্তার আছে। এই ঘটনা এখনও পরিষ্কার না। আরও দুই একদিন পরে কিছুটা পরিষ্কার হবে।"
"সংগঠিত আকারে সহিংসতা যে হচ্ছে, তা ঠিক বলা যাচ্ছে না" উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, "এখন তো রাজনৈতিক অস্থিরতা, দেশের আইনশৃঙ্খলা শিথিল হয়ে আছে। তাই হয়তো এসব ঘটছে।"
মূলত, পাকিস্তান আমল থেকেই ঝিনাইদহ এলাকায় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টি, জাসদ গণবাহিনী নামক ইত্যাদি দলের আধিপত্য ছিল– এমনটা জানিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক নয়ন খন্দকার বলছিলেন, "আগে এক সপ্তাহ, ১৫দিন, এক মাস পরপর এরকম হতো। ২০০০ সালে, ২০০৬ সালে, ২০০৭ সালে হয়েছে। কিন্তু ২০১০ সালের দিকে থেমেছে।"
"গত সরকারের আমলে এই ধরনের ঘটনা হয় নাই বললেই চলে" উল্লেখ করে তিনি বলেন যে এরকম ঘটনা ঘটলে "এরা (যারা হত্যার দায় নেয়) স্থানীয় পত্রিকায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বা ফোন করে বলে দেয় যে এরা আমাদের শত্রু, এরা এসব কর্মকাণ্ড করেছে, এজন্য এদেরকে মারা হয়েছে।"
এসব দলের কর্মকাণ্ড নতুন করে শুরু হয়েছে জানিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকরা আরও জানিয়েছেন যে একসময় একেক দলে ৫০ থেকে ১০০ জন করে সদস্য ছিল।
ঝিনাইদহ জেলা বিএনপি`র সভাপতি এম এ মজিদ বলেন, "আগেও এরকম ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন সময় একেকটি আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির আবির্ভাব হয়...। এখন যদি আবারও এভাবে হত্যা হয়, গোলাগুলি হয়... তাহলে সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করবে।"
"এই ঘটনার পেছনে কারা আছে, তা খুঁজে বের করা দরকার। কারণ আইন-শৃঙ্খলার অবনতি করার জন্য কেউ এগুলো করতে পারে," যোগ করেন তিনি।
খুলনার সাংবাদিক হেদায়েৎ হোসেন বিবিসি বাংলাকে জানান, নব্বইয়ের দশকে খুলনা অঞ্চলে জাসদ গণবাহিনীর তৎপিরতা ছিল। মূলত কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহে ছিল তাদের বিচরণ। মাদারীপুর ও ফরিদপুরেও তাদের প্রভাবের খবর পাওয়া গেছে সেসময়।
"এই দলটির ভেতরে মুকুল বাহিনী নামে একটি শাখার সক্রিয় এক সদস্যের নাম ছিল কালু। ২০০১-`০২ সালের দিকে তার গতিবিধি শুরু হয়। ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময়ে সর্বশেষ তার তৎপরতার খবর পাওয়া গেছে। পরে এক সময় সে ভারতে পালিয়ে যায় বলেও শোনা যায়," বলছিলেন তিনি।
সাংবাদিকদের কাছে যে বা যারা বার্তা পাঠিয়েছে সে বা তারা চরমপন্থি দলের সদস্য কিনা এখনই তা বোঝা কঠিন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।