প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫, ০৬:৪৫ পিএম
সাতক্ষীরা জেলার মোজাফফর গার্ডেন এন্ড রিসোর্টে সূর্যমণি প্রকল্পের ‘স্থানীয় পর্যায়ে জ্ঞান বিনিময় কর্মশালা` অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, এইচএসবিসি ব্যাংকের অর্থায়নে, কেয়ার বাংলাদেশ (CARE Bangladesh) এর বাস্তবায়নে Developing Sunflower value chain for sustainable farm household income at the Southwest coastal region of Bangladesh (SuRJaMoNi ) সূর্যমণি প্রকল্প উচ্চমূল্যের ফসল প্রবর্তন, ধান-ভিত্তিক শস্যবিন্যাসকে পরিপূরক করে, এবং বাজার সাথে সংযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে সূর্যমুখীর ভেল্যু চেইন (value chain) শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করছে।
বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০ টায় সাতক্ষীরা জেলার মোজাফফর গার্ডেন এন্ড রিসোর্টে ‘স্থানীয় পর্যায়ে জ্ঞান বিনিময় কর্মশালায়` প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন সাতক্ষীরা ডিএই, উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ সাইফুল ইসলাম, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রনয় বিশ্বাস, সহকারী কমিশনার (সাধারণ), ডিসি অফিস, সাতক্ষীরা এবং মোঃ জহুরুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, কলারোয়া, সাতক্ষীরা। এছাড়াও কর্মশালায় বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি ও সূর্যমুখী চাষিরা অংশগ্রহণ করেন।
কর্মশালার শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মোঃ আবিদ উল কবির, প্রোগ্রাম ম্যানেজার-গ্রীন ইনোভেশন, হিউম্যানিটারিয়ান অ্যান্ড ক্লাইমেট অ্যাকশন প্রোগ্রাম। তিনি জানান, সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া ও তালা উপজেলায় পতিত জমির কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধির জন্য "সূর্যমণি" প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১,০০০ - ১,২০০ বিঘা মৌসুমি পতিত জমিকে চাষের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, "আমরা কেবলমাত্র কৃষকদের জমি ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছি না, বরং উন্নত কৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বাজারজাতকরণের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছি। এই প্রকল্পের মাধ্যমে জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে, যা কৃষকদের দীর্ঘমেয়াদে লাভবান করবে।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা কৃষকদের সূর্যমুখী চাষে আগ্রহী করতে উন্নত বীজ, জৈব ও রাসায়নিক সার, চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিযন্ত্র ও প্রশিক্ষণ প্রদান করছি। এছাড়া কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার সৃষ্টি, সংরক্ষণ ও মূল্য সংযোজনের জন্য কার্যকর ভ্যালু চেইন গয়ে তোলা হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য শুধুমাত্র কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা নয়, বরং কৃষকদের আয় ও জীবনমান উন্নত করা।"
প্রকল্পের পক্ষে প্রজেক্ট ম্যানেজার মোঃ শাহাবুদ্দিন শিহাব বলেন, " এইচএসবিসি ব্যাংকের সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির অধীনে কেয়ার বাংলাদেশ গত এপ্রিল ২০২৪ থেকে ‘সূর্যমণি’ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করেছে। প্রকল্পের মাধ্যমে ১২২৫টি পরিবার জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার ও উন্নত ভ্যালু চেইন তৈরির মাধ্যমে উপকৃত হবে। প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের উন্নতমানের সূর্যমুখী বীজ, জৈব ও রাসায়নিক সার, ফসল সংরক্ষণ প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। বিশেষ করে, সূর্যমুখী চাষের মাধ্যমে পতিত জমির কার্যকর ব্যবহারের পাশাপাশি কৃষকদের আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
গত বছর প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে কলারোয়া উপজেলার কুশোডাঙ্গা, যুগিখালী ও দেয়াড়া ইউনিয়নে ৩০০টি পরিবারের মধ্যে ২০০ পরিবারকে বসতবাড়িতে নিরাপদ সবজি চাষের জন্য বিভিন্ন কৃষি উপকরণ সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া, ১০০ পরিবারকে মাঠ পর্যায়ে সবজি চাষের জন্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি, ১০১ পরিবারকে ৮০ বিঘা মৌসুমি পতিত জমিতে সূর্যমুখী চাষের জন্য উন্নত জাতের বীজ ও প্রয়োজনীয় সার দেওয়া হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা শুধু চাষীদের প্রশিক্ষণ দিয়েই থেমে থাকছি না, বরং একটি কার্যকর ভ্যালু চেইন তৈরির জন্য কাজ করছি। এতে চাষীরা তাদের উৎপাদিত সূর্যমুখী বাজারজাত করতে সুবিধা পাবেন এবং তাদের মুনাফা বৃদ্ধি পাবে। আমরা আশা করছি, এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের আয় ৩-৫ গুণ বৃদ্ধি পাবে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।"
কলারোয়া কুশোডাঙ্গা এলাকার কৃষক প্রতিনিধি সূর্যমুখী চাষী মোঃ আজিজুল ঢালী বলেন, "আগে আমরা ধান কাটার পর জমি পতিত ফেলে রাখতাম, কিন্তু সর্যমণি প্রকল্প থেকে কারিগরি সহায়তা পেয়ে এবার সূর্যমুখী চাষ করেছি। এতে আমরা লাভের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি।"
কলারোয়া যুগিখালী তালুন্দিয়া গ্রাম থেকে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা কৃষক আমেনা বেগম বলেন, "আমাদের এলাকার অনেক কৃষক আগে সূর্যমুখী চাষ সম্পর্কে জানতেন না। কিন্তু এখন প্রকল্পের সহায়তায় আমরা নতুন প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ পাচ্ছি, যা আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধি করছে।"
কর্মশালায় বিএআরআই-এর ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শিমুল কুমার মন্ডল বলেন, "বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) সূর্যমুখীর উন্নত জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি উন্নত জাত চাষীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।"
প্রধান অতিথি কৃষিবিদ মোঃ সাইফুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, "দেশে বছরে ভোজ্য তেলের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন, যার মাত্র ১২% দেশীয় উৎপাদন থেকে আসে। সূর্যমুখী চাষের সম্প্রসারণ হলে আমরা ভোজ্য তেল আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে পারবো। সরকার কৃষকদের জন্য নানামুখী সহায়তা দিচ্ছে, যা তাদের লাভজনক কৃষিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিচ্ছে।"
বিশেষ অতিথি সাতক্ষীরা ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইন-চার্জ, বিনা ডাঃ শিল্পী দাস বলেন, "সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া ও তালা উপজেলায় বৃহৎ পরিসরে সূর্যমুখী চাষ সম্প্রসারণ করা গেলে কৃষকদের আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।"
এস.এম. এনামুল ইসলাম, ইউএও, কলারোয়া, তার বক্তব্যে বলেন, "সূর্যমুখী চাষ সপ্রসারণের মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। সরকার এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায় বর্তমানে কৃষকরা উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার শিখছেন, যা তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়তা করছে। বিশেষ করে, পতিত জমির কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করে সূর্যমুখী চাষের মাধ্যমে কৃষকদের অতিরিক্ত আয় অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করছি, যাতে তারা উন্নত বীজ, সার এবং আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন।"
তিনি আরও বলেন, "এই কর্মশালার মাধ্যমে আমরা কৃষকদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যেও সমন্বয় বৃদ্ধি করতে পারব, যা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে।"
বক্তব্যে হাজিরা খাতুন, ইউএও, তালা বলেন,"সূর্যমুখী চাষে কৃষকদের সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ বাড়ানো গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সাতক্ষীরা অঞ্চল ভোজ্য তেল উৎপাদনে বড় ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবে।"
এই কর্মশালার মাধ্যমে সূর্যমুখী চাষের গুরুত্ব, চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা নিয়েও বিশদ আলোচনা করা হয়। অংশগ্রহণকারী কৃষক ও কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেন যে এই উদ্যোগ কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে।