প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩১, ২০২৫, ১১:১৯ পিএম
নিজস্ব প্রতিবেদক: সাতক্ষীরার কলারোয়ায় বিএনপিসহ অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের একটি অংশের ত্রাসে অতিষ্ঠ স্থানীয় জনগন। কলারোয়া উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খালিদ মন্জুর রোমেল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব আরিফুর রহমান রন্জু এবং সাবেক উপজেলা যুগ্ম সম্পাদক এস এম রিপনের নেতৃত্বে এই ত্রাসের বাহিনী গড়ে উঠেছে। স্থানীয়রা বলছেন,রোমেল-রন্জু এবং রিপন বাহিনীর তান্ডবে অসহায় সবাই। এই তিনজনই শেখ হাসিনার গাড়িবহর মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত আসামী। সম্প্রতি জামিনে বের হয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। এই বাহিনী ব্যবসায়ীদের থেকে শুরু করে সমাজের সম্পদশালীদের ফোন করে চাঁদা দাবি করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। নারীদের ইজ্জ্বতহানীর ঘটনাও ঘটিয়েছে। চাঁদার টাকা না দিলে মারপিট করে। এই বাহিনীর আয়ের আরেকটি বড় উৎস্য মাদক ব্যবসা। প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসার পাশপাশি মাদক সেবনও করেন এই বাহিনীর সদস্যরা।
সম্প্রতি চাঁদা না দেয়ায় কলারোয়া উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক জামানউদ্দিন টুটুলকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে এই রোমেল-রন্জু। পরবর্তীতে টুটুলকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় বৃহস্প্রতিবার মামলা করা হয়েছে। ভুক্তভোগী টুটুলের পিতা বিএনপি নেতা মো. শফিউদ্দিন মন্টু রোমেল-রন্জু বাহিনীর দুই প্রধানসহ আরও কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে এ মামলা করেন। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামসুল আরেফিন।
থানা সূত্রে জানা গেছে, মামলা নম্বর ১৯। মামলায় উপজেলা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খালিদ মন্জুর রোমেল এবং উপজেলা জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবকদলের সদস্য সচিব আরিফুর রহমান রন্জু ও সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মমতাজুল ইসলাম চন্দনের বন্ধু দেবুকে এজহারনামীয় আসামি করে আরও চার-পাঁচজনের বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়েছে।
জানা গেছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে এই বাহিনী কলারোয়ায় চাঁদাবাজি, ডাকাতি, অপহরণ, লুটপাটসহ নানা ধরণের অপকর্ম করে আসছে। প্রভাবশালী এই বাহিনীর বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছিল না। এ ঘটনায় মামলার পরপরই আসামীদের গ্রেপ্তারের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কলারোয়া থানা পুলিশ বললেও বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্নচিত্র। আসামী রোমেল-রন্জু প্রকাশ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশের নাকের ডগায় নিজের মামলা প্রত্যাহারের জন্য রন্জু মানবন্ধনও করেছে। কিন্তু গ্রেফতার করছে না পুলিশ।
মামলার এজহার থেকে জানা গেছে, গত বুধবার দুপুরে জামানউদ্দিন টুটুলকে দা দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত করেছে রোমেল-রন্জুর নেতৃত্বাধীন বাহিনী। হত্যার উদ্দেশ্যে টুটুলের ওপর এই হামলা হয়। উপজেলার যুগিবাড়ি নদীর মাটিকাটাকে কেন্দ্র করে উপজেলা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খালিদ মন্জুর রোমেল এবং উপজেলা জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবকদলের আরিফুর রহমান রন্জুর নেতৃত্বে এই হামলা হয়। এই ঘটনার পর তাৎক্ষনিকভাবে টুটুলকে কলারোয়া হাসপাতালে ভর্তি হয়। মাথায় তিনটা সেলাই দিয়ে চিকিৎসকরা বিশ্রামের জন্য বাড়িতে পাঠান। পরবর্তীতে মাথা ঘুরি পড়ে গেলে পুনরায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি আছে। তার অবস্থা আশংকাজনক।
মামলার এজহারে বলা হয়েছে, টুটুলের মাটির ব্যবসা আছে। নদী থেকে ইটভাটায় মাটি উত্তোলন করতে গেলে দেশীয় অস্ত্রসহ উপস্থিত হয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে রোমেল-রন্জু বাহিনী। টুটুল চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি করলে উভয় পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে টুটুলের মাথায় দা দিয়ে কোপ মারেন সাবেক উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সেক্রেটারি রোমেল। শাবল দিয়ে আঘাত করেন বর্তমান উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব রঞ্জু। তাৎক্ষনিক মাটিতে লুটিয়ে পড়েন টুটুল। এ সময় রোমেল-রন্জুর সাথে উপস্থিত ছিলেন তাদের অন্যতম সহযোগী দেবু।
বিগত ৫ আগস্টে সরকারের পট পরির্তনের পর কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন রোমেল-রন্জু। বিভিন্ন লোকজনের বাসাবাড়ি লুট, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে সবকিছুর সাথে জড়িয়ে পড়ে। রোমেল-রন্জু বাহিনীর অত্যাচারে কলারোয়ার সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে যায়। মাদক ব্যবসা থেকে মাদক গ্রহণ সবকিছুতেই তারা জড়িত হয়। রোমেল বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিবের ভাগ্নে। আর রন্জু কলারোয়া প্রেসক্লাবের আহবায়ক ও কলারোয়া উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব তাওফিকুর রহমান সন্জুর আপন ভাই। এজন্য স্থানীয় পত্রপত্রিকায় নিউজের উপরও এক প্রকার অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে।
সম্প্রতি সাংবাদিক পলাশ চৌধুরীকে টেলিফোন করে ১ লাখ টাকা দাবি করে রোমেল। এর আগে চাহিদ টাকার ২৫ হাজার রোমলকে, ৩০ হাজার রিপনকে দেয়া হলেও বাকি টাকার জন্য আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে তারা। সাংবাদিক পলাশ চৌধুরীর ভাই সাবেক উপজেলা আওয়ামী লীগের আহবায়ক হওয়ায় এলাকায় থাকতে ১লাখ টাকার চাঁদা দাবি করে তারা।
একইভাবে ব্যবসায়ী বাপ্পীকে টেলিফোন করে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে রোমেল। বাপ্পীর স্ত্রীকে জোরপূর্বক নিজের জিম্মায় রেখে দেয় রোমেল বাহিনী। ওই ব্যবসায়ীর স্ত্রীকে নিয়ে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করেন রোমেল। এর আগে কলারোয়া থানায় একজন নারী রোমলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করতে এলেও মামলা নেয়া হয়নি। পরবর্তীতে টাকার বিনিময়ে সেটি আপোষ করারা হয়।
এদিকে রোমেল-রন্জু-রিপন বাহিনীর অন্যতম সহযোগী স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা মুসা কারিম। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাদের বাসায় তল্লাসী করে টাকা পয়সা, সিমেন্ট, রডও লুট করে কারিম। এছাড়াও দেবুর যুগীবাড়িতে একটি বিশেষ আস্তানায় এই বাহিনীর নিয়মিত গোপন মিটিং হয়। সেই সব মিটিংয়ে মাঝে মাঝে জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক চন্দনকেও রাখা হয়। এই বাহিনীর অন্যতম সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছে কাজীরহাটের নজরুল চোর, ব্রাজবাক্সার হাইব্রিড গালিব, আশরাফ চেয়ারম্যানের ছেলে পিচ্চি আবিদ, ট্রলি শহীদুল, টাইগার খোকন প্রমুখ। আওয়ামী লীগ নেতাদের বাসায় চুরিও করছে এসব নেতারা।
বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা হাবিবুল ইসলাম হাবিবকে এসব বিষয়ে বারবার সতর্ক করারা হলেও তিনি কোন অভিযোগ আমলে নেননি। কলারোয়ার ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের সেইসব জনবিচ্ছিন্ন নেতাকর্মীকে হাবিব প্রশ্রয় দেয়ায় মাঠের ত্যাগীরা চরম বিরক্ত। তারা বলছেন, যে কলারোয়ায় বিগত ২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত একটি মিছিল করবার যোগ্যতা ছিলো না তারা এখন বড় বড় নেতা। স্থানীয় বিএনপি-অঙ্গ সংগঠনের বেশিরভাগ পদ আবার হাবিবুল ইসলাম হাবিবের পরিবারের ভীতরেই। এই পরিবারের সদস্যদের কলারোয়ার রাজনীতিতে অতিরিক্ত নাক গলানো, বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা করা,অনৈতিক তদবির করানো নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও ওই পরিবারটি দলের কমিটি বাণিজ্যে নেমে পড়েছে। সম্প্রতি ঘোষিত উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের অবৈধভাবে টাকার বিনিময়ে কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি গঠন করে দেন হাবিবের ভাতিজা মমতাজুল ইসলাম চন্দন।
এদিকে, চন্দনের কাছের অনুসারি ক্যাডার মুসা কারিম, কুশোডাংগা শিবির আলমগীর, যুগীখালীর মটরসাইকেল আসাদ, গুটিবাজ মিলন, পৌরসভার ফেন্সী দোয়েলদের দিয়ে রন্জু, দেবুর উপস্থিতিতে মানববন্ধন করিয়েছে। এ নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির অন্ত:কোন্দলের সুযোগে অনেকটা মাঠ গুছিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে জামায়াত। উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে কলারোয়া বিএনপির রাজনীতি। দৃশ্যত মুখোমুখী অবস্থানে আছে বিএনপির দুই গ্রুপ। যে কোন সময়ে বড় ধরণের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে।
কলারোয়া থানার ওসি শামসুল আরেফিন বলেন, যুবদল নেতা হত্যাচেষ্টার বিষয়ে ভুক্তভোগীর পিতা বাদী হয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে আগেও অসংখ্য অভিযোগ ছিলো। সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তারে করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।