প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২২, ২০২৪, ০৬:১৫ পিএম
কারো বয়স সত্তোর বছর, কারো বা আশি। পঞ্চাশ থেকে ষাট বছর বয়সী অনেকে এসেছেন। একে অপরের সাথে দেখা চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর পর। সব বয়স, বাধা ফেলে এক হয়েছেন একদিনে এক জায়গায়। এতবছর পর সহপাঠি, বন্ধুকে কাছে পেয়ে উচ্ছসিত তারা। সে এক আবেগঘন মুহুর্ত। প্রাণের টানে এমনই মিলনমেলা বসেছিল পাবনার পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে মাঠে।
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ। আলোকিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পায়ে পায়ে পূরণ করলো একশ’ বছর। আর এই দিনটিকে স্মরণীয়ে করে রাখতে দুইদিনব্যাপী জমকালো শতবর্ষ উৎসবের আয়োজন করে স্কুলটির প্রাক্তণ ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা।
শুক্রবার (২১ ডিসেম্বর) থেকে শুরু হয় দু’দিনব্যাপী আয়োজন। অনুষ্ঠানের আগেরদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাণের টানে নিজ এলাকা ঈশ্বরদীতে ছুটে আসেন। শনিবার (২২ ডিসেম্বর) আনন্দ শোভাযাত্রা, স্মৃতি চারণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বর্ণিল আয়োজনে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের শতবর্ষ পূর্তি উৎসব উদযাপন করা হয়।
শুক্রবার সকাল থেকেই তারা হাজির হন উৎসবের স্থান পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে মাঠে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ও দেশের বাইরে থেকে আসেন প্রাক্তণ সব শিক্ষার্থীরা। একসাথে পড়াশোনা করা তাদের কেউ মধ্যবয়সী, কেউবা ভয়সের ভারে ন্যুজ। দীর্ঘবছর পর প্রিয় বন্ধু সহপাঠীকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরেন। খোঁজ খবর নেন একে অপরের। অনেকে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। আনন্দ উচ্ছাস আর গল্প আড্ডায় ফিরে যান সেই স্কুল জীবনে। মেতে উঠেছিলেন খুনসুটিতে।
শনিবার সকালে বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে মাঠ থেকে একটা বর্ণিল শোভাযাত্রা বের হয়। শতবর্ষ পূর্তি উৎসবের থিম সং এর সুরে হাতি, ঘোড়ার গাড়ি, ব্যানার, ফেস্টুন, বাদ্য বাজনার তালে নেচে গেয়ে শোভাযাত্রা নিয়ে স্মৃতিঘেরা স্কুল প্রাঙ্গণে মিলিত হন শিক্ষার্থীরা। স্কুলের প্রধান ফটকে গিয়ে অনেকেই স্মৃতি ধরে রাখতে ছবি তোলেন। কেউবা স্কুলের পাশে মসজিদ প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখেন।
শোভাযাত্রা শেষে দীর্ঘ বছর পর নিজেদের প্রিয় স্কুলের আঙিনায় পা রাখেন প্রাক্তণ শিক্ষার্থীরা। সেখানে জাতীয় সংগীতের সাথে সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষর্থীরা। জাতীয় সঙ্গীত শেষে হাত তুলে জাতীয় পতাকাকে সম্মান প্রদর্শণ করেন তারা। এর আগে স্কুলের ঘন্টা বাজিয়ে লাইন ধরে দাঁড়ান প্রাক্তণ শিক্ষার্থীরা। শুধু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই নয়, দেশের বাইরে থেকেও বন্ধুরা আসেন নিজেদের স্কুলের শতবর্ষ আয়োজনে। আনন্দ ভাগাভাগি করতে পেরে উচ্ছসিত তারা।
এরপর বিকেলে রেলওয়ে মাঠে প্রধান অতিথি হিসেবে জাতীয় সঙ্গীতের সুরে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মো. আফজাল হোসেন। এ সময় প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা পুরনো বন্ধুদের সাথে স্মৃতিচারণ ও আড্ডায় মেতে ওঠেন। সন্ধ্যায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দু’দিনের উৎসব।
চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের ৬৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত রেলওয়ে কর্মচারী কাজী বদরুল হক মুক্তা বলেন, ‘মনে হচ্ছে নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছি। স্কুলের কত স্মৃতি মনে পড়ছে। আমি আমার বন্ধু আলাউদ্দিন খেলাধুলায় ভাল ছিলাম। আমরা স্কুলের খেলায় একে অপরকে ল্যাঙ মেরে ফেলে দিতাম। যাতে নিজেরা প্রথম হতে পারি। আমার সেই বন্ধু আলাউদ্দিনের সাথে দেখা হলো। শেষ বয়সে অনেক ভাই বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে অনেক ভাল লাগলো।’
৮৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী ব্যবসায়ী আব্দুল হক ও জিন্নাহ হক বলেন, ‘দীর্ঘ ৪০ বছর পর বন্ধু বান্ধবদের সাথে দেখা হলো। এই শতবর্ষ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য জন্য খুবই উচ্ছসিত ছিলাম। তাই আমেরিকা থেকে ছুটে আসছি। স্কুলের স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো। অনেক সময় স্কুলের অ্যাসেম্বলী ফাঁকি দিতাম। শিক্ষকরা খুব কড়া শাসনে রাখতেন আমাদের। মাঝে মধ্যে অ্যাসেম্বলী না করায় শিক্ষকদের ভয়ে আর স্কুলে না গিয়ে বাড়িতে চলে যেতাম।’
৯২ ব্যাচের শিক্ষার্থী আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমরা প্রিয় স্কুল ঘুরে আসলাম। ছেলেবেলার স্মৃতি মনে পড়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। স্কুলের পাশে মসজিদটি দেখে মনে পড়লো যখন আমরা স্কুল ফাঁকি দিতাম তখন ওই মসজিদের বারান্দায় ঘুমিয়ে থাকতাম। আজ আমরা আবার প্রাণ ফিরে পেলাম, মনে হলো আমাদের বয়স সেই ১৪ কি ১৫ বছর বয়সে ফিরে গিয়েছি।’
৮৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী বর্তমানে ব্যবসায়ী আকতার উজ্জামান ও জিয়াউল হক বলেন, ‘জীবন সন্ধিক্ষণে ছোট্ট ছোট্ট সময় যে বন্ধুগুলো পেয়েছি, প্রায় দীর্ঘ ৪৮ বছর পর সেই বন্ধুদের সাথে দেখা হলো। সেই সময় কে কি করছি অনেক স্মৃতি রোমন্ধন করলাম, সেইদিনে ফিরেছিলাম আমরা। একে অপরের সাথে ভবিষ্যতে যোগাযোগের জন্য মোবাইল নাম্বার রাখলাম। এক কথায় স্কুলজীবনের সময়টা ছিল প্রাকৃতিক। আর বর্তমান এখন যান্ত্রিক। তাই এমন আয়োজন খুব দরকার ছিল।’
শতর্বষ উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব আশরাফ আলী খান মঞ্জু বলেন, ‘এই স্কুলের শতবর্ষ উৎসব আয়োজনে আমরা সবচেয়ে পুরাতন ১৯৫৪ সালের শিক্ষার্থী একজনকে খুঁজে পেয়েছি আমরা। ১৯৫৮ সালের একজনকে পেয়েছি। এই মিলনমেলায় সকলেই আনন্দিত। ফেলে আসা দিনগুলোকে সবাই একদিনে ফিরিয়ে এনে আনন্দ ভাগাভাগি করেছি আমরা। এই প্রাপ্তিটাই আয়োজনের সার্থকতা। শতবর্ষ উৎসবে প্রাক্তণ শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার মিলে অন্তত দশ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মো. আফজাল হোসেন বলেন, ‘এত বড় একটি আয়োজনে আমি উপস্থিত থাকতে পেরে খুবই আনন্দিত, অভিভূত। নিজেকে ধন্য মনে করছি। না আসলে বুঝতে পারতাম না এত সুন্দর আয়োজন, এত মানুষের উপস্থিতি। এই আয়োজন নতুন ও পুরাতনের মধ্যে একটি মেলবন্ধন তৈরী করবে মনে করি।’