প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২২, ২০২৪, ১২:৫০ পিএম
দরিদ্র পরিবারের এক মাত্র ছেলে রানা (২০)। পরিবারের হাল ধরার জন্য কাজের খোঁজে গিয়েছিলেন ঢাকায়। ঠিক তখনি ঢাকাসহ সারা দেশে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়।
গত ২৫ জুলাই কাজ বন্ধ থাকায় ঢাকার বসুন্ধরা এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের শটগানের গুলিতে আহত হন রানা। জ্ঞান ফিরে দেখেন হাসপাতালে বেডে শুয়ে আছেন তিনি। কেটে ফেলা হয়েছে তার ডান হাত। বাঁ হাতটিও ঝলসে গিয়ে পুরোটাই অকেজো। অর্থকষ্টে এখন চিকিৎসা করাতে পারছেন তার পরিবার, বন্ধ রয়েছে চিকিৎসা।
রানা নীলফামারী সদর উপজেলার গোড়গ্রাম ইউনিয়নের তিলবাড়ী ময়দানপাড়া গ্রামের দিনমজুর মিজানুর রহমান এবং মা সাবিনা ইয়াসমিনের ছেলে।
ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে প্রায় তিন মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর অর্থের অভাবে উন্নত চিকিৎসা করতে না পেরে গত ১৮ অক্টোবর বাড়িতে ফিরে আসেন রানা। বাড়ি ফেরার ১৫ দিন পর ডাক্তার আবারো ঢাকায় নিয়ে পরীক্ষা করাতে বললেও টাকার অভাবে নিতে পারেনি তার পরিবার।
রানা ছল ছল চোখে বলেন, ‘ঘটনার দিন দুপুরে বসুন্ধরা এলাকায় শিক্ষার্থীদের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় পুলিশের টিয়ার শেল, শটগানের গুলি চলতে থাকে আমাদের ওপর। পুলিশের গুলি থেকে বাঁচতে পালাতে চেষ্টা করি। হঠাৎ একটি বিকট শব্দে মাটিতে পড়ে যাই আমি। এরপর আর কিছুই বলতে পারি না। জ্ঞান ফেরার পরে দেখি আমি হাসপাতালের বেডে। আমার ডান হাতের কবজি থেকে নেই। আর বাঁ হাতটি ঝলসে গিয়ে অবশ।’
কেন ঢাকায় গিয়েছিলেন জানতে চাইলে রানা কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘আমার বাবা একজন দিনমজুর। অনেক কষ্ট করে আমাদের পাঁচ সদস্যের পরিবার চলে। তাই বাবাকে সহযোগিতার জন্য কাজের খোঁজে ঢাকায় যাই। ওইদিন কাজ বন্ধ থাকায় সেখানে ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে চিরদিনের জন্য হাত দুটি হারিয়ে ফেলি। আমার চিকিৎসার জন্য বাবার যতটুকু সহায় সম্বল ছিল, সবকিছু শেষ করেও সুস্থ হতে পারিনি। আমি এখন সমাজ ও পরিবারের বোঝা।’
রানার বাবা মিজানুর রহমান জানান, ‘ঘটনার তিন দিন পর হাসপাতাল থেকে ফোন আসে যে, আপনার ছেলে ছাত্র আন্দোলনে গুরুতর আহত হয়ে ঢাকার বার্ন ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি আছে। খবর পেয়ে ছেলের চিকিৎসার জন্য ওইদিন আমি বাড়ির একটি গরু ও একটি ছাগল বিক্রি করে টাকা নিয়ে ছেলের কাছে যাই। হাসপাতালে গিয়ে দেখি ছেলের ডান হাতের কবজি থেকে কাটা এবং বাঁ হাত ঝলসে গেছে। গোটা শরীর শটগানের ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা। কিন্তু ওই সামান্য টাকায় তার কিছুই হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ছেলেকে সুস্থ করতে বাড়ির গরু-ছাগল বিক্রি করে এবং অন্যের কাছ থেকে ধারদেনা করে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করেছি। কিন্তু তারপরও সে পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। টাকার অভাবে তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। ডাক্তার রানাকে ১৫ দিন পর ঢাকায় নিয়ে পরীক্ষা করাতে বলছিলেন। কিন্তু টাকার অভাবে তাকে নিয়ে যেতে পারিনি। এছাড়া রানার অপর হাতটিও চিকিৎসার অভাবে দিন দিন অচল হয়ে যাচ্ছে।’
রানার বাবা আক্ষেপ করে বলেন, ‘আন্দোলনে গুলি খেয়ে আমার ছেলে পঙ্গু হলো। আজ নতুন বাংলাদেশের সুফল সবাই ভোগ করছে। গত চার মাসেও সরকারের লোকজন খোঁজখবর নিতে এলো না। চিকিৎসা বাবদ একটি টাকাও কেউ দিলো না।’
স্থানীয় প্রতিবেশীরা জানান, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এসব তরুণদের ভূমিকা ভোলার নয়। অথচ আজ রানাকে পরিবারের বোঝা হয়ে সারাজীবন থাকতে হবে। তাই দেশবাসী এবং সরকারের কাছে তার চিকিৎসা জন্য অনুরোধ জানাই।’
ইউপি সদস্য সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘রানা আমার প্রতিবেশী। তার বাবা একজন দিনমজুর। বাবাকে সাহায্য করতে কাজের জন্য ঢাকায় যায় রানা। গত জুলাই মাসে ছাত্র জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে সে একটি হাতই হারায় আর একটি হাত অচল হয়ে যায়। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে না পেরে সে এখন পঙ্গু। আমি তার চিকিৎসার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সাহায্যের অনুরোধ করছি।
নীলফামারী জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জেলার যে তিন জন শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারকে আমরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছি। একজন শহীদ পরিবারের সদস্যকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা আহত হয়ে আমাদের কাছে আসছেন আমরা তাদের সহযোগিতা করেছি। এদিকে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকেও তাদেরকে সহযোগিতা ও আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও যারা আহত হয়েছেন তাদের তালিকা নিয়ে আমরা কাজ করছি।’