প্রকাশিত: আগস্ট ২৯, ২০২৪, ০২:৫৭ পিএম
তালুকদার আব্দুল খালেক। খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির পাশাপাশি ছিলেন খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) তিনবারের মেয়র। এর আগে তিনি বাগেরহাট-৩ আসনের সংসদ-সদস্য এবং সাবেক ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের মেয়র থাকার সুবাদে কেসিসির ঠিকাদারি কাজে সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি। তার আমলে বেশির ভাগ কাজ পেয়েছেন তার পছন্দের ঠিকাদার। এমনকি কাউন্সিলরদের মধ্যেও করেছেন বৈষম্য।
বাগেরহাটের রামপালে গ্রামের বাড়ি হলেও খুলনা নগরীর ২নং কাস্টমঘাট এলাকায় বছর দুয়েক আগে সাড়ে ছয় তলা বাড়ি করেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদ্য বিদায়ি কেসিসি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক। এর আগে তিনি খুলনায় ভাড়া থাকতেন। তবে ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে। বিক্ষুব্ধ জনতা তার বাড়িটি ভাঙচুর করেছে। সম্প্রতি খালিশপুর থানায় বিএনপি অফিস ভাঙচুরের মামলায় তিনি আসামি হয়েছেন।
ক্ষমতাসীন দলের সাবেক এই নেতা মেয়র থাকাকালীন লাগামহীন দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ছিল ঠিকাদারি কাজে। সিটি করপোরেশনের নির্দিষ্ট কয়েকজন ঠিকাদারকে দিয়ে তিনি বেনামে সেই কাজে অংশীদার থাকতেন। এছাড়া তার দুর্ব্যবহারের কারণে করপোরেশনে যেতে সবার ভয় লাগত। তার আমলে কাউন্সিলরদের মধ্যে ছিল বৈষম্য। টিসিবি থেকে শুরু করে নানান অনুদানে তিনি প্রভাব বিস্তার করতেন।
ঠিকাদারি কাজে তার স্বজনপ্রীতির কারণে আজ খুলনার অর্ধেক জায়গাই চলাচলের অনুপযোগী বলে অভিযোগ নগরবাসীর।
আরও জানা যায়, তিনি মেয়র থাকাকালীন মেসার্স হোসেন ট্রেডার্স, আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্স ও মেসার্স তাজুল ইসলাম-এ তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি ৫ শতাংশ কমিশনের ভিত্তিতে ঠিকাদারের কাছে বিক্রি, লাইসেন্স ছাড়াই পছন্দের ব্যক্তি, আওয়ামী লীগের নেতা ও কাউন্সিলরদের মধ্যে ঠিকাদারি কাজ ভাগ করে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় মন্ত্রণালয়ের কথা বলেও ঠিকাদারদের কাছ থেকে নেওয়া হতো টাকা। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে সাবেক মেয়র কাজ করেছেন, সেসব বেশির ভাগ ঠিকাদারই এখন পলাতক রয়েছেন।
২০২৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেছেন তার নগদ টাকা আছে ৪ কোটি ৭৯ লাখ। চারটি ব্যাংকে জমা আছে ১ কোটি ১৮ হাজার টাকা। ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও ১৮ লাখ টাকার পোস্টাল এফডিআর রয়েছে তার। দুটি গাড়ির মালিক তিনি। এর মধ্যে একটি গাড়ির দাম দেখিয়েছেন ৪৪ লাখ টাকা এবং মাইক্রোবাসের দাম দেখিয়েছেন ১৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। তার এসি, টিভি, ফ্রিজ ও ওভেনের মূল্য ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা এবং আসবাবপত্রের মূল্য ৭ লাখ টাকা। অথচ ২০০৮ সালে নির্বাচনের সময় হলফনামার তথ্য অনুযায়ী তার বার্ষিক আয় ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। তার কাছে নগদ টাকা ছিল ৫৭ হাজার ৫৫০। সম্পদ বলতে ছিল ব্যাংকে জমা ১৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, সঞ্চয়পত্র ও স্থায়ী আমানতে ২৮ লাখ টাকা।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, ঠিকাদারি কাজ পাওয়ার ব্যাপারে স্বজনপ্রীতি রয়েছে। কোনো জবাবদিহি নেই। খুলনা নগরীর অর্ধেক জায়গাই চলাচলের অনুপযোগী। রাষ্ট্রের অর্থ খরচ করে কষ্ট না কমিয়ে বাড়ানো হয়েছে। অনেক ওয়ার্ডে যানবাহন চলাচলা করার উপায় নেই।
কেসিসি ঠিকাদার জাহিদ হাসান খসরু জানান, ইজিপি টেন্ডারে কাজ হতো। সেখানে অংশ নিলেও তালুকদার আব্দুল খালেকের নির্দিষ্ট ফার্মে টিক দেওয়া থাকত। তিনি নিজেও বেনামে ঠিকাদারি কাজ করতেন। নির্দিষ্ট চার-পাঁচটি ফার্মে কাজ করতেন সাবেক কেসিসি মেয়র, এটি সবাই জানে।
কেসিসির সাবেক কাউন্সিলর মো. হাফিজুর রহমান মনি বলেন, তালুকদার আব্দুল খালেকের আমলে ব্যাপক বৈষম্য ছিল। টিসিবির কার্ড বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সুবিধা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দেওয়া লাগত। কোনো প্রণোদনার কার্ড আমাকে দেওয়া হয়নি। শীতকালীন বস্ত্র নিয়েও বৈষম্য ছিল।
খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনা বলেন, আওয়ামী লীগের ১৭ বছরে নগরীতে কেউ কাঙ্ক্ষিত সেবা পায়নি। সাধারণ মানুষ সিটি করপোরেশনে গেলে দুর্ব্যবহারের স্বীকার হয়েছে। প্রত্যেক পর্যায়ে দলীয়করণ করেছে। এমনকি ওয়ার্ড অফিসে গিয়েও সেবা পাওয়া যায়নি।
কেসিসির সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, ড্রেন সংস্কারের নামে রাস্তার পাশের সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। জনবান্ধব পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা হয়নি। দুর্নীতি ছিল মাত্রাহীন ও লাগামহীন। ইজিবাইকের কারণে নগরে বিশৃঙ্খলা বেড়েছে।