• ঢাকা বুধবার
    ০৫ মার্চ, ২০২৫, ২০ ফাল্গুন ১৪৩১

‘বান আসিল আর হামার কষ্ট বাড়িল বাহে’

প্রকাশিত: জুলাই ৪, ২০২১, ০৯:২৯ এএম

‘বান আসিল আর হামার কষ্ট বাড়িল বাহে’

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি

‘বান আসিল আর হামার কষ্ট বাড়িল বাহে। প্রত্যেক বছরে বান আসলে হামরা চরের মানুষ এমনি লকডাউনোত পড়ি যাই। নাই খাওয়া, নাই বেড়াকোড়া, ঘর আর উচা বাঁধ হইল হামার থাকার জাগা। নদীর ভাঙলে ঘরবাড়ি নিয়া দৌড়াদৌড়ি তো আছেই’—এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন পর পর পাঁচবার ধরলা নদীর ভাঙনে ভিটেমাটি হারানো আইয়ুব আলী। তিনি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার কদমতলা গ্রামের মাঝের চর এলাকার  বাসিন্দা।  

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর অতি বর্ষণের ফলে সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামের অর্ধশতাধিক চরাঞ্চল পানিতে নিমজ্জিত। দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা। গত চার দিন ধরে টানা বৃষ্টিতে ধরলা, দুধকুমর, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রসহ জেলার বেশ কয়েকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তীরের মানুষেরা পড়েছেন বিপাকে। 

একদিকে সরকার ঘোষিত করোনাকালীন লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অনেকে। অন্যদিকে নদী ভাঙনের তীব্রতায় পরিবার নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে জেলার নিম্নাঞ্চলের মানুষজন। 

সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, জেলার সাড়ে চার শ চরাঞ্চলের প্রায় অর্ধশতাধিকেরও বেশি গ্রামে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। এর মধ্যে উপজেলা রৌমারী, রাজারহাট, রাজীবপুর ও নাগেশ্বরী উপজেলা ও কুড়িগ্রাম সদরের কিছু এলাকায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে করে নিম্নাঞ্চলের সবজিক্ষেত, ফসলি জমি তলিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন কৃষকেরা। 

তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে হলোখানা ইউনিয়নের সারডোবা গ্রাম, উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের একাংশ, মোগলবাসা ইউনিয়নের চর কৃষ্ণপুর ও চর সিতাইঝাড় গ্রামসহ সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের জগমনের চর ও যাত্রাপুর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম।

জেলায় এ পর্যন্ত নদী ভাঙনে শতাধিক ঘরবাড়ি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ফসলি জমি, রাস্তাঘাট ও হাট-বাজার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। 

বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের আবু বক্কর সিদ্দিক সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, গত দুই মাস ধরে নদী ভাঙনের কারণে ভিটেমাটি হারিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছি। ২ লাখ টাকা ঋণ করে কিছু আবাদি জমি কিনেছিলাম; সেটাও নদী কেড়ে নিল। এখন আমি পরিবার-পরিজন নিয়ে কী খাব, কেমনে ঋণ পরিশোধ করব।

ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের জগমনের চরের আবিয়া বেগম বলেন, ‘তিন তিনবার নদী হামার ভিটেমাটি কেড়ে নিছে। এবার বাঁধে আসি বাড়ি করলং। গতকাল নদী ভাঙনে সে ভিটেও নদীত চলি গেইছে। এলা কোনডাই ঘর তুলমো। মোক এখনা কোঠে মাথা গোঁজার ঠাঁই দিবে। তোমরা মোক একনা ব্যবস্থা করি দেও ভাই।’ 

ভোগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান বলেন, নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তিন দিনে ইউনিয়নের আটটি পরিবারের ভিটেমাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। আমরা এসব নদী ভাঙা পরিবারের তালিকা করে জেলা প্রশাসন বরাবর পাঠিয়েছি। সরকার ব্যবস্থা নিলে অবশ্যই ভুক্তভোগীরা উপকৃত হবেন।

সদর উপজেলার হলোখানা ইউপি সদস্য মোক্তার হোসেন জানান, তার বাড়ির কাছে তিনটি রাস্তা বন্যার পানিতে ভেঙে গেছে। ফলে যাতায়াতের দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। 

তিনি আরও জানান, সারডোবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৬০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। গত তিন দিনে এখানে ২০টি পরিবার ভিটা হারিয়েছে। বিকল্প বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে প্রায় ১৫টি গ্রাম।

মোগলবাসা ইউনিয়নের চর সিতাই ঝাড় গ্রামের বুল বুল মিয়া বলেন, ‘গত এক মাসে নদী হামার দুবার বাড়ি ভাঙিল। চর সিতাইঝাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছিল; সেটাও গতবার নদী ভাঙি নিয়ে গেছে। গ্রাম রক্ষায় এলাকাবাসী মানববন্ধন করলং। পানি উন্নয়ন বোর্ড হামাক আশা দেইল বানের আগে জিও ব্যাগ ফেলাইবে। কই আজ পর্যন্ত কোনো খবর নাই।’

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে জেলার সবগুলো নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও এখনো বিপৎসীমার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তিনি আরও জানান, মধ্য জুলাইয়ের আগে বড় বন্যার আশঙ্কা নেই। যে সব এলাকায় নদী ভাঙন চলছে তা চিহ্নিত করে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, শনিবার দুপুর পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন পয়েন্টের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদের নুনখাওয়া পয়েন্টে পানির সমতল ২৪.৮8 মিটার। যা বিপৎসীমার (২৬.৫০ মিটার) ১৬২ সেন্টিমিটার নিচে। ব্রহ্মপুত্র নদ চিলমারী পয়েন্টে পানির সমতল ২২.৬০ মিটার, বিপৎসীমার (২৩.৭০ মিটার)  ১১০ সেন্টিমিটার নিচে। ধরলা নদী কুড়িগ্রাম সদর পয়েন্টে পানির সমতল ২৫.৫৯ মিটার, বিপৎসীমার (২৬.৫০ মিটার) ৯১ সেন্টিমিটার নিচে। তিস্তা নদী কাউনিয়া পয়েন্টে পানির সমতল ২৮.৮৫ মিটার, বিপৎসীমার (২৯.২০ মিটার) ৩৫ সেন্টিমিটার নিচে।

টিআর/এএমকে/সবুজ
আর্কাইভ