প্রকাশিত: জুন ২৭, ২০২৩, ০১:৪৬ এএম
‘সোনার নাগালা বাড়ি ঘর থুইয়া যাইয়া সড়কের ডালে থাউইন লাগে। বাড়ির স্মৃতি এখন তিন হাত জায়গা। সেটাতেও ভাঙনে ফাটল ধরছে।’ কথাগুলো বলছিলেন টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী ইউনিয়নের চিতুলিয়াপাড়ার গ্রামের হনুফা বেগম (৬৫)। নদী ভাঙনে ঘর হারিয়ে পাশের সড়কের উঁচু জায়গায় পরিবারের সঙ্গে থাকছেন তিনি।
সরেজমিনে উপজেলার চিতুলিয়াপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, গত দুই সপ্তাহে চিতুলিয়াপাড়া গ্রামের শতাধিক পরিবার যমুনার ভাঙনে তাদের বসতভিটা হারিয়েছে। এদের অনেকেই পাশের সড়কের ঢালে ঘর তুলে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। দুই দিন পরই ঈদ। সব জায়গায় ঈদের আমেজ শুরু হলেও ভাঙনে দিশেহারা পরিবারগুলোতে সেই আনন্দ নেই। সবাই ঘরবাড়ি সরাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। দিনরাত সমানতালে ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে প্রমত্তা যমুনা নদী।
চিতুলিয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা জিলকদ (৫০)। তার বাড়ি যেখানে ছিল সেখান থেকে যমুনা নদীর দূরত্ব ছিল প্রায় দেড় কিলোমিটার। তবে কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ভাঙনে তার বাড়িটিও গত শুক্রবার নদী গর্ভে চলে গেছে। এখন জিলকদের পরিবার নিয়ে থাকার জায়গা।
জিলকদ বলেন, পুরাতন জনপদ গিলে খাচ্ছে যমুনা নদী। ৬০ বছর আগে এখানে বাড়ি করেছিলাম। আজ নদী গর্ভে চলে গেছে সব। এখন নিঃস্ব অসহায়ভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছি। যার বাড়ি-জমি নেই তার কষ্টের সীমা নেই।
একইভাবে ভাঙনের শিকার হয়েছেন মগরব আলী। তিনি পেশায় একজন আইসক্রিম বিক্রেতা। তবে অসুস্থতার কারণে আইসক্রিমও বিক্রি করতে পারেন না। হতদরিদ্র মগরব আলীও ভাঙনে বসতভিটা হারিয়েছেন। পরে তার স্ত্রীকে নিয়ে সড়কের ঢালে ঝুপড়ি ঘর তুলে থাকছেন।
মগরব আলীর স্ত্রী জহুরা বেগম বলেন, রাতের মধ্যে ঘরবাড়ি চলে গেছে নদীতে। টিউবওয়েলটিও রক্ষা করতে পারলাম না। কিছু জিনিসপত্র বাঁচিয়ে ছিলাম। সেগুলো স্বামী-স্ত্রী মিলে সরিয়ে নিচ্ছি। ঘরে খাবার নেই। কয়েকদিন আগে মেয়েটাও মারা গেছে। ফলে কেউ দেখার নেই আমাদের। শত শত পরিবার যমুনা নদীর ভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন।
জানা গেছে, টাঙ্গাইলে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে ভাঙন শুরু হয়েছে। জেলার নাগরপুর, ভূঞাপুর, কালিহাতী ও মির্জাপুরের বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে নাগরপুরে ধুবরিয়া ও সলিমাবাদ এবং ভূঞাপুরে গোবিন্দাসী ইউনিয়নের কষ্টাপাড়া, ভালকুটিয়া ও চিতুলিয়াপাড়ায় ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে সলিমাবাদের পরিত্যক্ত ঘোষণা করা একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভেঙে নদী গর্ভে চলে গেছে। ভূঞাপুরে যমুনা নদী ক্রমেই ভেঙে পূর্ব দিকে ধাবিত হয়ে পশ্চিম দিকে চর জাগছে। ভাঙনের ফলে অনেকেই বাস্তুহারা হয়েছেন। কেউবা আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি। কেউবা সড়কের ওপর ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করছেন।
ভাঙন কবলিতরা জানান, ভাঙনের শতাধিক পরিবার আশ্রয়হীন হলেও কোনো জনপ্রতিনিধি তাদের খোঁজ নেয়নি। এছাড়া প্রশাসন থেকেও কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি। আগে সমাজবদ্ধভাবে ঈদ পালন করলেও এবার সেই ঈদ করতে পারবেন না তারা। ভাঙনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজও ভেঙে গেছে।
ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. দুলাল হোসেন চকদার বলেন, ইতোমধ্যে ভাঙনে একটি গ্রামের শতাধিক পরিবার বসতভিটা হারিয়েছে। দ্রুত ভাঙন রোধে কাজ শুরু না করলে মাটিকাটা হতে কষ্টাপাড়া পর্যন্ত যে বাঁধ রয়েছে সেটি ভেঙে যাবে।
ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বেলাল হোসেন জানান, ভাঙনের বিষয়টি জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড কতৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এছাড়া ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, জেলায় দুই উপজেলার কয়েকটি স্থানে বেশি পরিমাণে ভাঙন শুরু হয়েছে। বন্যার সময় জিও ব্যাগের মাধ্যমে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। যাতে ভাঙনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটা কম হয়। এছাড়া ভূঞাপুরে অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রস্তাবনা রয়েছে। সুতরাং ওখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে তীর সংরক্ষণের আওতায় চলে আসবে। এতে উপজেলার গোবিন্দাসী, নিকরাইল এলাকায় আর নদী ভাঙন হবে না। তবে নাগরপুরে কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এডিবির আওতায় নাগরপুরে চার কিলোমিটার অংশে জিও ব্যাগ দ্বারা প্রতিরক্ষামূলক একটা কাজের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জেকেএস/