প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২৩, ০৭:১৮ পিএম
‘অনেক ধরনের মরদেহ গোসল করাইতে হয়। মাঝেমধ্যে খারাপ লাগে, কষ্টও হয়। যখন ছোট বাচ্চাদের মরদেহ গোসল করাইতে হয় তখন খুব আফসোস হয়। অনেক সময় গোসল করাইতে গিয়ে মনে হয় আমরাও তো একদিন চলে যাব, আমাদেরকেও এভাবে গোসল করিয়ে নিয়ে যাবে। এই ভেবে কান্না চলে আসে।’
এভাবেই মরদেহ গোসল করানোর অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন রোজিনা বেগম। তিনি নীলফামারীর ডোমার পৌর এলাকার পূর্ব চিকনমাটি গ্রামের তমিজ উদ্দীনের স্ত্রী। ষাটোর্ধ্ব এই নারী প্রায় ২০ বছর ধরে ধাত্রীর কাজের পাশাপাশি মরদেহ গোসল করানোর কাজ করছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার মৃত নারী ও কন্যাশিশুর গোসল দিয়েছেন তিনি।
সিটি নিউজ ঢাকাকে রোজিনা বেগম বলেন, আগে থেকেই আমি বাচ্চা প্রসবের কাজ করি। এছাড়া প্রায় ২০ বছর আগে স্থানীয় একজনের সঙ্গে মরদেহের গোসলে সহযোগিতা করতে গিয়ে কাজটা শিখেছি। তখন থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার মৃত নারী ও কন্যাশিশুর গোসল দিয়েছি। এমনও দিন গেছে রাত ৩-৪টার সময়ও মরদেহের গোসল দিতে হয়েছে। অনেক সময় আমি একাই সেখানে চলে যাই।
মরদেহের গোসল দিতে ভয় লাগে কিনা এমন প্রশ্নে রোজিনা বেগম বলেন, ভয় লাগে না। তবে মাঝেমধ্যে অনেক মরদেহের চোখ মেলানো থাকে, চেহেরা অন্য রকম হয়ে যায়, তারপরও গোসল করাই। আর বাচ্চা খালাস করার অভিজ্ঞতার কথা তো আছেই।
রোজিনা বেগম সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, গোসল করানোর সময় অনেকের শরীরে মলমূত্র লেগে থাকে, সেটা পরিষ্কার করতে হয়। মনটা যদি ঠিক থাকে তাহলে এসব কাজে তেমন ঘৃণা লাগবে না। আমরা মরদেহ গোসল দেওয়ার সময় হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার করি। কিছুদিন আগে একজনের গোসল দিয়েছি। কিন্তু নারীর অবস্থা খুব খারাপ ছিল। এমন হয়েছিল গোসল করানোর সময়ও পায়খানা আসছিল। এছাড়া এরকম অনেক স্মৃতি আছে, কারও নাকমুখ দিয়ে মল আসে। সবার মৃত্যু যেমন এরকম হয় না, তেমনি মরদেহও একই আশা করা যায় না।
মরদেহ গোসল দেওয়ার একেকটা ঘটনা বলতে গিয়ে নিজের পরিবারের কষ্টালাপও করেন রোজিনা বেগম। তিন মাস আগে তার স্বামী তমিজ উদ্দীন স্ট্রোক করেছেন। দিনমজুর স্বামীর এমন অসুস্থতায় সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি এই বৃদ্ধা।
তিনি সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, এখন তো আমার স্বামী চলতে পারেন না। তিন মাস হয়েছে উনি স্ট্রোক করেছেন। আগে দিনমজুরের কাজ করতেন। আমি আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী, উনার আগের স্ত্রীর দুই ছেলে রয়েছে। আমার কোনো সন্তান নেই। কারও কাছে কিছু চাই না, নিজেই করে খাই। বাচ্চা খালাস করে কিছু টাকাপয়সা ও কাপড় পাই, এসবে কোনোরকমে দিন চলে যাচ্ছে। তবে আমি মরদেহ গোসল দিয়ে কারও কাছ থেকে টাকাপয়সা নিই না।
রোজিনা বেগম বলেন, কোনো সময় রাতে গোসল করানোর পর আবার সেই মরদেহকে সকালেও পরিষ্কার করতে হয়। মরদেহকে তো ভালো করে পরিষ্কার করে দিতে হয়, তা না হলে তো আমরা দায়ী থাকব। গোসল করানোর সময় ৪-৫ জনকে সঙ্গে রাখা হয়।
রোজিনা বেগম শুধু মরদেহের গোসল দিয়েছেন এমনটা নয়, তিনি অনেক নারীকে এই মহতী কাজটি হাতেকলমে শিখিয়েছেনও। যাদের তিনি শিখিয়েছেন এখন তারাও রোজিনাকে মাঝেমধ্যে মরদেহ গোসলের কাজে সহযোগিতা করে থাকেন।
মরদেহ গোসল দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডোমার জামিয়া ইসলামিয়া আমিরুন্নেছা মহিলা মাদরাসার শিক্ষিকা আরিফা আক্তার সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, মুসলিম কেউ মারা গেলে পুরুষরা পুরুষদের ও নারীরা নারীদের গোসল দিবেন, এটাই নিয়ম। মৃতদের গোসল করানো আমাদের জীবিত মুসলিমদের জন্য দ্বায়িত্ব। আমরা যারা গোসল করাতে জানি তাদের সুন্নত তরিকায় সুন্দর করে গোসল দেওয়া দ্বায়িত্ব।
ডোমার পৌরসভার কাউন্সিলর নাসিমা বেগম সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, আমাদের এখানে পুরুষ মারা গেলে পুরুষ ও নারী মারা গেলে নারীরা গোসল দেন। ৪-৫ জন মিলে এই গোসল দেওয়ার কাজটা করে থাকেন। তবে গোসল দেওয়ার কাজটা সবাই পারেন না। রোজিনা বেগমসহ এলাকার কয়েকজন নারী আছেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে এই মহতী দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
বিএস/