• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ০৭ নভেম্বর, ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

প্রলয় গ্যাংয়ের আছে গ্যাংষ্টার বাহিনী

প্রকাশিত: মার্চ ২৯, ২০২৩, ০৪:১০ এএম

প্রলয় গ্যাংয়ের আছে গ্যাংষ্টার বাহিনী

ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অপকর্ম করে আসা ‘প্রলয় গ্যাংয়ের’ সদস্যদের অপরাধের আরও অনেক তথ্য বেরিয়ে আসছে। আলোচিত এই গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে ওয়াসার পানির পাম্পের কক্ষ দখল করে ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় বোতলজাত পানির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক ইন্টার্ন চিকিৎসককে মারধরে জড়িত থাকাসহ নানা অভিযোগ সামনে আসছে। পাওয়া গেছে নতুন আরও কয়েকটি গ্যাংয়ের সন্ধান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের (দ্বিতীয় বর্ষ) কিছু ছাত্র মিলে প্রলয় গ্যাং তৈরি করেন। দীর্ঘদিন ধরেই ক্যাম্পাস এলাকায় নানা অপকর্ম করে এলেও সম্প্রতি এক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনার পর গ্যাংয়ের সদস্যদের পরিচয় সামনে আসে। গত শনিবার রাতে কবি জসীমউদ্‌দীন হলের মাঠ এলাকায় গ্যাংয়ের সদস্যরা পিটিয়ে রক্তাক্ত করেন তাঁদেরই সহপাঠী জোবায়ের ইবনে হুমায়ুনকে। এ ঘটনায় প্রলয় গ্যাংয়ের ১৯ সদস্য ও অজ্ঞাতনামা ৬-৭ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন জোবায়েরের মা সাদিয়া আফরোজ খান। ওই মামলায় গ্যাংয়ের সদস্য সাকিব ফেরদৌস ও নাঈমুর রহমান ওরফে দুর্জয় ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন।

আলোচিত প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যদের অপরাধের অনুসন্ধান করতে গিয়ে একই ধরনের আরও কয়েকটি গ্যাংয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব গ্যাংয়ে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, হেনস্তা, মারধর ও মাদক সেবনে জড়িত তাঁরা।

প্রলয় গ্যাংয়ের ‘দখল-বাণিজ্য’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকার বিভিন্ন দোকানি ও ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাদের অভিযোগ, প্রলয় নামের এই গ্যাংয়ের সদস্যরা তাঁদের একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের (আইল্যান্ড) বোতলজাত পানি রাখতে বাধ্য করছেন এবং ওই পানি না রাখলে তাঁদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন।

কয়েক মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ‘ছবির হাট’ নামক ফটকের পাশে অবস্থিত ওয়াসার জিমখানা পানির পাম্পের একটি কক্ষ দখল করেন প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যরা। ওই কক্ষ আইল্যান্ড ব্র্যান্ডের পানির বোতল রাখার কাজে ব্যবহার করেন তাঁরা। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এই ব্যবসার সঙ্গে প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্য ছাড়াও তাঁদের কিছু ‘বড় ভাই’ও জড়িত আছেন। গ্যাং সদস্যদের এসব ‘বড় ভাই’ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা বলে জানা গেছে।

ওয়াসার পানির পাম্পের কর্মচারীরা বলছেন, পানি রাখতে না দিলে তাঁদের পাম্প ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যরা। তাঁরা নিজেদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা বলে পরিচয় দিতেন।

ইন্টার্ন চিকিৎসককে মারধর
গত বছরের ৮ আগস্ট রাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় মারধরের শিকার হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক। এ কে এম সাজ্জাদ হোসেন নামের ওই চিকিৎসক সে সময়ে অভিযোগ করেছিলেন, সেদিন রাতে তিনি একা শহীদ মিনারে বসে ছিলেন। এ সময় কয়েকজন যুবক এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয় দিয়ে তাঁর পরিচয় জানতে চান। যুবকদের প্রায় সবার গায়ে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো-সংবলিত টি-শার্ট। নিজের পরিচয় দেওয়ার পরও তাঁরা তাঁকে মারধর করেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদ (ইচিপ) কর্মবিরতিও পালন করেছিল।

এ ঘটনার আট মাস পেরোলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের শনাক্ত করে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। সম্প্রতি প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যদের সচিত্র পরিচয় সামনে আসার পর তাঁদের ছবি দেখে হামলার শিকার সাজ্জাদ হোসেন ধারণা করছেন, শহীদ মিনারে তাঁকে মারধরে জড়িত ছিলেন এই গ্যাংয়ের সদস্যরা।

সাজ্জাদ হোসেন গতকাল সোমবার সিটি নিউজ ঢাকাকে জানিয়েছেন, ‘প্রকাশিত হওয়া ছবি দেখে মনে হচ্ছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের ছাত্র তবারক মিয়া আমার ওপর হামলায় জড়িত ছিলেন। হামলার পরই তবারক আমার সন্দেহের তালিকাতেও ছিলেন। তখন তবারক ও তাঁর এক বড় ভাই আমাকে বলেছিলেন, তবারক ওই ঘটনায় জড়িত নন। কিন্তু এখন তবারক ও তাঁর সহপাঠীদের নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ দেখে আমার ধারণা হয়েছে, আমাকে হামলায় তিনি জড়িত ছিলেন।’

তবারক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের ছাত্র। প্রলয় গ্যাংয়ের অন্যতম এই নেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জোবায়ের ইবনে হুমায়ুনের মায়ের করা মামলার ১ নম্বর আসামি। ঘটনার পর তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন।

আরও গ্যাংয়ের সন্ধান
প্রলয় গ্যাং নিয়ে আলোচনার মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসভিত্তিক একই ধরনের আরও কয়েকটি গ্যাংয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের কিছু শিক্ষার্থীর একটি গ্যাং ক্যাম্পাস এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে নানা অপকর্ম করেছে। সিনিয়র হয়ে যাওয়ায় এখন আর তারা সরাসরি এসব অপকর্ম করে না। ‘ছোট ভাইদের বিপদ-আপদে’ তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। এ গ্যাংয়ের কয়েকজন এখন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

প্রলয় ছাড়াও ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় সক্রিয় আছে ‘নিশাচর’ নামে আরও একটি গ্যাং। এর নেতৃত্ব দেন ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের কিছু শিক্ষার্থী। ফেসবুকে গ্যাংটির ‘নিশাচর’ নামে একটি গ্রুপ আছে। এই গ্যাংয়ের সদস্যরাও ছিনতাই-চাঁদাবাজি, হেনস্তা-মারধর ও মাদক সেবনের মতো নানা অপকর্মে জড়িত। এ গ্যাংয়ের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের গ্রুপের কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হওয়ার পরই অন্যরা সতর্ক হয়ে যায়।’

এ ছাড়া ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের কিছু শিক্ষার্থী ‘নিশাচর–২’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের কিছু শিক্ষার্থীও জড়িত রয়েছেন একই ধরনের অপকর্মে। নিশাচর–২ গ্যাংয়ের এক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের গ্রুপে ৭০-৮০ জন সক্রিয় সদস্য আছেন। এর মধ্যে অনেকে ছাত্রলীগের পদধারী নেতা। গ্রুপের সবাই অপকর্মে জড়িত থাকে না। রাজনীতি করার কোনো ইচ্ছাই নেই, এমন সর্বোচ্চ ১০-১৫ জন অপকর্মে জড়িত। দীর্ঘ মেয়াদে রাজনীতি করার ইচ্ছা থাকলে কেউই এ ধরনের অপকর্মে জড়াতে পারে না। এরা শুধু রাজনীতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে।’

‘প্রলয় গ্যাং’ সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে সক্রিয় ছিল। আলোচনায় আসার পর গ্যাংয়ের নেতারা এখন পলাতক। এখন পর্যন্ত সর্বশেষ শিক্ষাবর্ষ হচ্ছে ২০২১-২২। এই শিক্ষাবর্ষের একটি গ্যাংয়ের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ফজলে নাভিদ ওরফে অনন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় কাভার্ড ভ্যান আটকে টাকা ছিনতাই এবং চালককে মারধরের অভিযোগে করা মামলায় গত ফেব্রুয়ারিতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ফজলে নাভিদ ও তাঁর দুই বন্ধু।

গ্যাংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়গুলো দেখছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে।

আর শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ বলেন, তাঁরা তদন্ত করছেন। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানাতে পারবেন।

দেশজুড়ে সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ