প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৩, ০৬:৫৮ পিএম
গত সাত দিনে ১০ টাকার মাছও বিক্রি করতে পারেননি মো. শাকিল (৩৫)। তাই জীবিকার তাগিদ গহিন পদ্মা নদীতে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। যদিও এ সময় পদ্মায় ঝড় তুফানের ভয়। তারপরও জীবন-জীবিকার তাগিদে বেঁচে থাকার জন্য যেতে হবে তাকে। নিজ জীবনের ঝুঁকি থাকলেও তা তিনি মোটেও পরোয়া করেন না। তবে ভয় শুধু চার বছরের মেয়ে সুহানাকে নিয়ে।
বেদে পরিবারের শাকিল তার স্ত্রী নুরজাহান এবং একমাত্র মেয়ে সোহানাকে নিয়ে নৌকায় বসবাস করেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে বড়শি দিয়ে মাছ ধরে যা আয় হয় তা দিয়ে চলে তাদের সংসার। সারা বছর যেখানে মাছ বেশি পাওয়া যায় সেখানেই নৌকা নিয়ে ছুটে চলেন, মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন।
শাকিলের জন্ম নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার সোমবারহাট এলাকায়। ছোটবেলা থেকে বাবা-মার সঙ্গে নদীতে ঘুরে ঘুরে মাছ ধরে জীবন কাটে তার। বাবা মারা গেছেন ১০ বছর আগে। চার বোনের মধ্যে তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। তারা বিভিন্ন স্থানে স্বামীর সঙ্গে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করেন। মায়ের সঙ্গে আছে ছোট বোন। তারা আলাদাভাবে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে মুঠোফোনের কল্যাণে এখন নিয়মিত পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। আগে বিচ্ছিন্ন হয়েই জীবন কাটত তাদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার রসুলপুর খেয়াঘাট সংলগ্ন ফুলদি নদীতে বসবাস করে বেশকিছু বেদে পরিবার। এদের মধ্যে অনেকেই এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও অনেকে যে মৌসুমে ভালো মাছ পাওয়া যায় শুধু সেই মৌসুমে ছুটে আসেন। চার মাস আগে ফুলদি নদীতে মাছ ভালো পাওয়ার খবর শুনে নারায়ণগঞ্জের বন্দর হতে ছুটে এসেছিলেন শাকিল। কিন্তু গত ৭ দিন হয় এখানে একেবারেই মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গহিন পদ্মার শরীয়তপুর জেলার সুরেশ্বর এলাকায় যাবেন। তাই পুরোনো নৌকার ছই (ছাদ) মেরামতের কাজে লেগে গেছেন। আর এ কাজে তাকে সহায়তা করছেন তার চার বছরের একমাত্র মেয়ে সুহানা।
শাকিল জানান, গত দুই দিন যাবত বাঁশ দিয়ে নৌকার চাল তৈরি করছেন। বাঁশের উপর বিছাতে হবে ছই (ছাদ)। তারপর নৌকাকে মালামত করতে হবে অর্থাৎ আলকাতরা দিতে হবে। এ কাজে সময় লেগে যাবে প্রায় সাত দিন। এসব করতে খরচ হবে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা।
তারপর ফুলদি নদী হতে স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে পদ্মার ওপারে শরীয়তপুর জেলার সুরেশ্বর এলাকায় পড়ি দেবেন। পদ্মা নদীতে যদি স্রোত এবং ঢেউ কম থাকে তাহলে একদিনে পার হয়ে যাবেন নদী। আর যদি ঢেউ ও স্রোত বেশি থাকে তাহলে পার হতে ২ থেকে ৩ দিন লেগে যাবে।
শাকিল বলেন, জিনিসের দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। আর নদীতে মাছ দিন দিন কমছে। তাই আমাদের জীবন অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন দুবেলা খেয়ে বেঁচে থাকাটাই অনেক কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমার একমাত্র মেয়েকে আর এ পেশায় আনতে চাই না। এখন ওর বয়স চার বছর, পাঁচ বছর হলেই একটি স্কুলে ভর্তি করে দিতে চাই।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে একটি বড় নৌকা বানাতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ হয় কিন্তু আমাদের উপার্জন একেবারেই কম।
শাকিলের স্ত্রী নুরজাহান আক্তার বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে মাছ ধরে যা আয় হয় তা দিয়ে আমাদের সংসার চলে। আমরা মাছ ধরা ছাড়া অন্য কাজ পারি না। অন্য বেদেরা সাপ খেলা দেখায় কিন্তু আমরা নিজেরাই সাপ দেখলে ভয় পাই। নৌকাতে বসবাস করি। ছোট মেয়েটাকে নিয়ে খুব ভয়ে থাকতাম কখন পানিতে পড়ে যায়। এখন সুহানা সাঁতার শিখেছে, তাই ভয় এখন একটু কম।
ওই স্থানে বসবাস করা হেনা বেগম (৬০) বলেন, ৫০ বছর ধরে এখানে বসবাস করছি। আগে এখানে ভালো মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন তেমন মাছ নেই। তাই চিন্তা করছি বাধ্য হয়ে এখান থেকে চলে যেতে হবে। জায়গাটাই অনেক দিন ধরে থাকি, কেমন মায়া জন্মায় গেছে। তারপরও না খেয়ে তো আর মরতে পারব না। দেখি যেখানে ভালো মাছ পাওয়া যায় সেখানে চলে যাব।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময়ে অনেক মানুষই আসেন, আমাদের সুখ-দুঃখের কথা ভিডিও করে নিয়ে যান। কিন্তু আমরা কোনো সহায়তা পাই না।
আরেক বাসিন্দা বাদল মিয়া (৭০) বলেন, ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মাছ ধরি। আজ ৬০ বছর হয় মাছ ধরে চলছি। আগে খালে-বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এখন অনেক খাল, বিল, নদী শুকিয়ে গেছে। মানুষ অনেক খাল-বিল ভরাট করে ফেলেছে। নদীতে মাছ নেই বললেই চলে। তাই আমাদের খুব কষ্ট করে এ পেশায় টিকে থাকতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জিয়াউল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করলে আমরা কীভাবে বুঝব তারা সমস্যায় আছে। তারপরও যখন শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয় আমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবার আগে তাদের দিয়ে থাকি।