প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৩, ০৬:২৬ পিএম
বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক ভালো ছিলো না মুনের। এদিকে ছোট বোন স্বামীর সঙ্গে গড়ে তোলে অনৈতিক সম্পর্ক। বোনকে সতর্ক করেও কিছু হয়নি। বিষয়টি বাবা-মাকেও জানান মুন। তারপরও এর সুরাহা হয়নি। নিজের সংসার ধরে রাখতে ও স্বামীকে পেতে খুন করেন বাবা, মা ও বোনকে। আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দিতে এসব জানিয়েছেন মেহজাবিন।
২০২১ সালের ১৮ জুন রাতে রাজধানীর কদমতলী এলাকায় চা, কপির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে অজ্ঞান করে বাবা মাসুদ রানা, মা মৌসুমি ইসলাম এবং বোন জান্নাতুল ইসলাম মোহিনীকে খুন করেন মেহজাবিন। এ ঘটনায় মাসুদ রানার বড় ভাই সাখাওয়াত হোসেন মেহজাবিন ও শফিকুলকে আসামি করে কদমতলী থানায় মামলা করেন।
মামলাটি তদন্ত করে গত বছরের ২২ আগস্ট মুনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন কদমতলী থানার ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) ফেরদৌস আলম সরকার। মুনের স্বামী শফিকুল ইসলাম অরণ্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ না পাওয়ায় তাকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়। স্বামীকে পেতে মুন মা-বাবা ও বোনকে খুন করেন মর্মে চার্জশিটে উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
এদিকে, পুলিশের দেওয়া চার্জশিটে গত ৬ অক্টোবর নারাজি দাখিল করেন বাদী সাখাওয়াত হোসেন। নারাজিতে উল্লেখ করেন, মামলার তদন্ত সঠিকভাবে হয়নি। মুন একা এত বড় ঘটনা ঘটাতে পারে না। আরও কারো যোগসূত্র রয়েছে। এজন্য মামলাটি পুনরায় তদন্তের আবেদন করেন তিনি। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরফাতুল রাকিবের আদালত মামলাটি সিআইডিকে পুনরায় তদন্তের আদেশ দেন। গত ৩০ জানুয়ারি মামলাটি পুনরায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ধার্য ছিলো। কিন্তু ওইদিন সিআইডি প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতাউল্লাহ আগামী ২ মার্চ প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ধার্য করেন।
চার্জশিট দাখিল করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কদমতলী থানার ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) ফেরদৌস আলম সরকার বলেন, মেহেজাবিন ইসলাম মুনের সাথে তার বাবা, মা ও বোনের কলহ ছিলো। এর জেরে, সম্পদের লোভ এবং তার স্বামীকে একান্তভাবে পেতে চা কফির সাথে তিনজনকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ায়ে অজ্ঞান করে শ্বাসরোধে তাদের হত্যা করে মুন।
মামলার বাদী সাখাওয়াত হোসেন বলেন, একটা মেয়ের পক্ষে তিনটা মানুষকে খুন করা সম্ভব না। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি এতে শফিকুল জড়িত। আগে থেকেই সম্পত্তি গ্রাস করার একটা মন মানসিকতা ছিলো। সে মুনকে প্ররোচিত করেছে খুন করতে। কারণ সে আগে থেকেই উগ্র ছিলো। একটা হত্যা মামলার এক নম্বর আসামিও। আর ঘটনার সময় শফিকুল ঘরে ছিলো। তার কিছুই হলো না।
তিনি বলেন, পুলিশ যা বলছে তা আমরা মানি না। বিষয়টা অন্য খাতে প্রবাহিত করতে এ কথা বলা হচ্ছে। তারা আমাদের হেল্প করেনি। আমরা চাই, ঘটনার প্রকৃত রহস্যটা উদঘাটন হোক।
চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা ফেরদৌস আলম বলেন, ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শফিকুলের সাথে মেহেজাবিন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। মাসুদ রানা ২৬ বছর ধরে সৌদি প্রবাসী। তার স্ত্রী মৌসুমী ইসলাম ও কন্যা জান্নাতুল ইসলাম মোহনী কদতমলী থানাধীন মুরাদপুরে একটি বাসায় ভাড়া থাকতো। মাসুদ রানা মাঝে মধ্যে এসে ভাড়া বাসায় থাকতেন। মেহেজাবিন তার স্বামী-সন্তান নিয়ে কদমতলীর পূর্ব জুরাইনের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। মাসুদ রানা সৌদি আরব থেকে বিভিন্ন সময় মূল্যবান সম্পদ তার স্ত্রী মৌসুমীর কাছে পাঠাতো। মোহনীকে লেখাপড়া শিখিয়ে ভালো পাত্রের কাছে বিয়ে দেওয়ার জন্য মৌসুমী সম্পদ সঞ্চয় করতে থাকেন। বাবার পাঠানো কোনো জিনিস মেহেজাবিনকে তার মা দিতেন না। এর ফলে তাদের মধ্যে কলহের সৃষ্টি হয়।
পক্ষান্তরে শফিকুল তার স্ত্রীর ছোটবোন মোহনীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। এ বিষয়ে মেহেজাবিন তার বোনকে বারবার সতর্ক করলেও সে কর্ণপাত করে না। মেহেজাবিন বিষয়টি তার বাবা-মাকেও জানায়। কিন্তু তারা কোনো সুরাহা করে না। এজন্য ২০২১ সালের হত্যার ঘটনার তিন মাস আগে মেহজাবিন তরমুজের সাথে চেতনানাশক ওষুধ খাওয়াইয়া তার বাবা-মা ও বোনকে হত্যার চেষ্টা করে। এতে ব্যর্থ হয়ে স্বামীকে একান্তভাবে পেতে বোন, মা ও বাবাকে হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকে। যা মেহেজাবিন আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও বলেছে।
তিনি বলেন, মেহেজাবিন প্রথমবার ব্যর্থ হয়ে পুনরায় তাদের হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১০ জুন রাত ৮টার সময় মুরাদপুরের একটি ফার্মেসি থেকে ৯টি, ১৫ জুন আরও দুইটি এবং ১৬ জুন ১০টি ঘুমের ওষুধ কেনে। ১৭ জুন শনিরআখড়া ফুটপাতের দোকান থেকে একটি চাপাটি ও কাচি কেনে। ১৮ জুন রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঘুমের ট্যাবলেট, চাপাটি, কাচি, স্বামী-সন্তানসহ বাবার বাসায় যায়। পূর্বের ভুল-ত্রুটির বিষয়ে ক্ষমা চায়। তারা তাকে ক্ষমা করেন। মেহেজাবিন বাসায় থাকতে চাওয়ায় ও অনেকদিন পর নাতনী বাসায় আসায় তাদের থাকতে বলেন মাসুদ রানা। খাওয়া দাওয়া শেষে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাত ১১টার দিকে চা কফির সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে সবাইকে খেতে দেয় মেহেজাবিন। তারা সবাই অচেত হয়ে গেলে বাসার মেইন দরজা বন্ধ করে বারান্দায় কাপড় শুকানোর রশি কেটে মায়ের পিঠ মোড়া দিয়ে হাত, পা বাঁধে। ওড়না দিয়ে বাবা ও বোনকে পিঠ মোড়া দিয়ে হাত, পা বাঁধে। ওড়না পেঁচিয়ে তিনজনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।
জানা যায়, মুন কারাগারে রয়েছেন। তার স্বামী শফিকুল এ মামলায় জামিনে থাকলেও অন্য মামলায় কারাগারে রয়েছে। তাদের মেয়ে দাদা, দাদির কাছে রয়েছে।