প্রকাশিত: জানুয়ারি ২২, ২০২৩, ০২:১৬ এএম
জাহেরা খাতুনের বয়স তখন ১৪ কিংবা ১৫। একদিন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে বের হন তিনিসহ আরও কয়েকজন। ওপারে গিয়ে হরিয়ে যান তারা। পৌঁছাতে পারেননি আত্মীয়ের বাড়িতে। শেষ পর্যন্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে বসে কান্না করছিলেন জাহেরা। জাহেরার কান্না দেখে এক বাসচালক তাকে নিয়ে যান। ওই বাসচালকের সহায়তায় জাহেরাকে বিয়ে করেন ভারতের জম্মু-কাশ্মীর প্রদেশের শ্রীনগরের আব্দুল মজিদ খান নামে এক কৃষক।
দীর্ঘ ৪০ বছর পর মোবাইলে যোগাযোগ করে অবশেষে নিজ পৈতৃক ভিটায় পরিবারের কাছে ফিরেছেন জাহেরা খাতুন (৫৫)। তিনি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামের মৃত রহমত আলীর মেয়ে। শনিবার (২১ জানুয়ারি) ভোরে তিনি তার পরিবারের কাছে পৌঁছান।
জানা গেছে, জাহেরা খাতুনের স্বামী আব্দুল মজিদ খান জম্মু-কাশ্মীরের শ্রীনগর পায়েরবালা এলাকার বাসিন্দা। বর্তমানে সেখানেই বসবাস জাহেরা খাতুনের। জাহেরা এখন ভারতীয় নাগরিক। মা-বাবার দেওয়া নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। তার নাম রাখা হয়েছে বিবি বেগম। তার সঙ্গে স্বামী আব্দুল মজিদ খানও এসেছেন। তিন যুগে বাংলা ভাষা ভুলে গেছেন জাহেরা । কথা বলেন হিন্দি ও উর্দু ভাষায়। যা বলা হচ্ছে তা শুধুমাত্র ইশারায় বোঝানো হচ্ছে। সেখানে তার এক কন্যা সন্তান রয়েছে। তার নাম ছামিরা। এক মাসের ভিসা নিয়ে বেড়াতে এসেছেন জাহেরা। দীর্ঘদিন পর তাকে কাছে পেয়ে আবেগ আপ্লুত পরিবারের সবাই।
জাহেরা খাতুনের ভাই লিয়াকত আলী বলেন, আমরা সাত ভাইবোন। তিন ভাই আর চার বোনের মধ্যে জাহেরা মেজো। জাহেরার বয়স যখন ১৪-১৫ বছর তখন আমার এক খালা ও চাচাতো বোনের সঙ্গে ভারতে বেড়াতে যায় সে। সেখানে গিয়ে আমার বোন হারিয়ে যায়। অনেক দিন পর আমার চাচাতো বোন রওশনারা বাড়ি ফিরে আসলেও। খোঁজ মেলেনি জাহেরার। তবে রওশনারা ফিরে এসে জাহেরার হারিয়ে যাওয়ার সব কথা খুলে বলে। তখন অনুমান করা হয় জাহেরা জম্মু-কাশ্মীরে রয়েছে। আমার বাবা-মা বেঁচে থাকা অবস্থায় অনেক চেষ্টা করেছি তাকে খুঁজে বের করার জন্য। মা নুরজাহান বেগম ও বাবা রহমত আলী এখন আর বেঁচে নেই। বেঁচে থাকতে তারা মেয়েকে একনজর দেখার আকুতি জানাতেন আল্লাহর কাছে। সে আশা পূরণ হয়নি তাদের।
অনেকদিন পর জানতে পারি জাহেরা কাশ্মীরে আছে। ঠিকানা জানা না থাকায় যোগাযোগ করতে পারিনি। পরে অনেক চেষ্টার পর ভারতের এক পরিচিতজনের কাছ থেকে মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে কথা বলে পরিচয় নিশ্চিত হই। আমার ছোট ভাই মিলকুল হোসেন গত বছর জাহেরা খাতুনের বাড়িতে বেড়াতে যায়। তারপর থেকে হারিয়ে যাওয়া বোনের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হয়। এক মাস আগে জানতে পারি আমার সেই হারিয়ে যাওয়া বোন আমাদের মাঝে আবার ফিরে আসছে। সেই থেকেই আমরা তার আসার অপেক্ষায় ছিলাম। পাঁচদিন আগে তারা বাড়ি থেকে বের হয়ে শনিবার ভোরে আমাদের কাছে পৌঁছেছে।
জাহেরা খাতুন বলেন, হারিয়ে যাওয়ার পর আমি বাড়ি ফেরার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। যখন দেখলাম আমি আর আমার পরিবারের কাছে যেতে পারবো না, তখন মা-বাবা ও ভাইবোনকে পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন পর এই বৃদ্ধ বয়সে হলেও নিজের দেশে নিজের গ্রামে ফিরে আসতে পারলাম ঠিকই কিন্তু মা-বাবাকে আর দেখতে পেলাম না। তবুও নিজের কাছে খুবই ভালো লাগছে আমারও একটি পরিবার আছে। যাদের কাছে আমি আসতে পেরেছি। এক মাসের ভিসা নিয়ে তারা স্বামী-স্ত্রী বেড়াতে এসেছেন বলে তিনি জানান।।
জাহেরা খাতুনের স্বামী আব্দুল মজিদ খান বলেন, জাহেরা খাতুনের সঙ্গে আমার বিয়ে হয় ১৯৮৪ সালের দিকে। বিয়ের পর তার পরিবারের কাছে এই প্রথম আসা। অনেকদিন অপেক্ষার পর আমার স্ত্রী তার ভাইবোনদের কাছে পেয়েছে। এটাই তার আবদার ছিল আমার কাছে। আমার স্ত্রীর পরিবারকে কাছে পেয়ে আমারও অনেক ভালো লাগছে। তার জন্য আমারও বাংলাদেশে আসা হলো। এই দেশটাকে দেখার সুযোগ হলো।
স্থানীয় ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, জাহেরা খাতুন বয়সে আমাদের অনেক বড়। ছোটবেলায় দেখেছি- তিনি ছিলেন অনেকটাই শান্ত প্রকৃতির। দীর্ঘদিন তার কোনো খোঁজখবর ছিল না। মোবাইলে পরিবারের লোকজন জাহেরার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে। অবশেষে শনিবার ভোরে জাহেরা পরিবারের কাছে পৌঁছেছে। জাহেরার ফিরে আসার খবর শুনে গ্রামের সবাই তাকে দেখতে ভিড় করছে।