• ঢাকা শুক্রবার
    ০৮ নভেম্বর, ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

চার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাস বন্ধ, বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানস্থলে!

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১২, ২০২৩, ০৫:৩৫ পিএম

চার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাস বন্ধ, বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানস্থলে!

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজারো শিক্ষার্থীর পাঠদান ব্যাহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বুধবার (১১ জানুয়ারি) এ ঘটনা ঘটে। ওই চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি ডিগ্রি কলেজ, দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে একটি বিদ্যালয়ের মাঠেই ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

এদিকে, ছাত্রলীগের সম্মেলনস্থলের বেশিরভাগ চেয়ারেই ওই চারটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বসে থাকতে দেখা গেছে। যাদের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ছিল। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পরনে ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পোশাক।

এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে একাধিক অভিভাবক জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগের সম্মেলনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। ওই সম্মেলনের কারণে চারটি প্রতিষ্ঠানে বুধবার (১১ জানুয়ারি) কোনো ক্লাস হয়নি বলে জানিয়েছেন অভিভাক ও শিক্ষার্থীরা।

বুধবার সকাল ১১টার দিকে উপজেলার মিয়ার বাজার লতিফুল নেছা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্থানীয় উজিরপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সম্মেলন ও ওয়ার্ড ছাত্রলীগ কমিটির পরিচিতি সভা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সম্মেলন উপলক্ষে সকাল ১০টার দিকেই আসতে শুরু করে সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এটি শেষ হয় বেলা সাড়ে ৩টার দিকে। সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক। তিনি কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে রয়েছেন।

এছাড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুস সোবাহান ভূঁইয়া হাসান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রহমত উল্লাহ বাবুল, উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি তৌফিকুল ইমলাম সবুজসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রহমত উল্লাহ ওই চারটি প্রতিষ্ঠানের একটি মিয়াবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষের পদে রয়েছেন। বাকি দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো- মিয়াবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মিয়াবাজার তোষণ রফিক বালিকা বিদ্যালয়। সম্মেলনস্থলের প্রতিষ্ঠান আর বাকি তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাছাকাছি স্থানে অবস্থিত।

তবে মিয়াবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষিকা ফেরদৌসী আক্তার এ ঘটনায় ভিন্ন দাবি করেছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফেরদৌসী আক্তার বলেন, আমরা ক্লাস বন্ধ রাখিনি। তবে বুধবার কোনো ক্লাসই নিতে পারেনি ছাত্রলীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে লাগানো মাইক আর সাউন্ডবক্সের কারণে। অতিরিক্ত আওয়াজের কারণে কোনভাবেই ক্লাস নেওয়া সম্ভব ছিল না। আর আমরা চেষ্টা করেছি শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই রাখতে। তবে সেখানে (সম্মেলনস্থলে) যখন গান (সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান) আরম্ভ হয়, তখন অনেক শিক্ষার্থী চলে যায় গান শুনতে।
মিয়াবাজার ডিগ্রি কলেজের অন্তত তিনজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, 
আমাদের অধ্যক্ষ স্যার উপজেলা আওয়ামী লীগের বড় নেতা। এখানে  ছাত্রলীগের কমিটি রয়েছে। তারাই আমাদেরকে সেখানে যেতে বাধ্য করেছেন। বুধবার কোনো ক্লাসই নয়। আমরা অনেকটা বাধ্য হয়ে সকাল ১০টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সেখানে ছিলাম।

লতিফুল নেছা উচ্চ বিদ্যালয় ও মিয়াবাজার তোষণ রফিক বালিকা বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বুধবার সকালে স্কুলে এলে স্যাররা আমাদেরকে বলেন, আজকে কোোন ক্লাস করা লাগবে না। এমপি সাহেবের প্রোগ্রামে যেতে হবে সবাইকে। তোমরা পুরো সময় গ্রোগ্রামে বসে থাকবে। শেষ হলে চলে যাবে। তাই আমরা সেখানে গিয়েছি।

এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে শহিদুর রহমান নামের এক অভিভাবক বলেন, ছাত্রলীগের একটি ইউনিয়ন সম্মেলনের জন্য চারটি প্রতিষ্ঠানের এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী দুর্ভোগে পড়া দুঃখজনক ব্যাপার। আর শিক্ষার্থীদের বাধ্য করে রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে নিয়ে বসিয়ে রাখার বিষয়টিও কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। এসব কারণে প্রতিনিয়ত শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে অতিথিরা সচেতন ছিলেন না বলে মনে হচ্ছে। কারণ তারা চাইলেই সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও সম্মেলন করা যেত। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের নেওয়ার জন্যই প্রতিষ্ঠান চালুর সময়ে সম্মেলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

নিয়মানুযায়ী সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিদ্যালয়ে পাঠদান চলার কথা। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কীভাবে বিদ্যালয়ের মাঠে ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়?

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ নিয়ে জানতে চাইলে সম্মেলনস্থল মিয়াবাজার লতিফুল নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক ওয়ালি উল্ল্যাহ বলেন, আমরা ক্লাস বন্ধ রাখিনি। সকাল বেলা ক্লাস হয়েছে। আর আমি এনিয়ে কথা বলে ঝামেলায় পড়তে চাই না। আপনি বিষয়টি নিয়ে মিয়াবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষের (উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) সঙ্গে কথা বলেন।  

এসব বিষয়ে জানতে উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি তৌফিকুল ইমলাম সবুজের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ নিয়ে কথা বলতে চাইলে উপজেলার মিয়াবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রহমত উল্লাহ বাবুল বলেন, আমি একটি অনুষ্ঠানে ব্যস্ত রয়েছি। এ নিয়ে পরে কথা বলবো আপনার সঙ্গে।

পরে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুস সোবাহান ভূঁইয়া হাসান বলেন, ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠানটি শুরু হয় মূলত বেলা ১২টার দিকে আর ২টার দিকে শেষ হয়ে যায়। এর আগে ওই চারটি প্রতিষ্ঠানে ক্লাস হয়েছে বলে জেনেছি। আর ছাত্রলীগ তো শিক্ষার্থীদেরই সংগঠন। এজন্য ছাত্রলীগকে ভালোবেসে অনেক শিক্ষার্থী সম্মেলনস্থলে এসেছে। আমি বিষয়টি অস্বীকার করছি না।

অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের সকল স্থানেই স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীরা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলে শিক্ষার্থীরা সেখানে উপস্থিত থাকে। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। আমি এখানে অন্যায়ের কিছু দেখছি না। এছাড়া অনুষ্ঠানে আসতে কাউকে আসতে বাধ্য করা হয়েছে, এমন কথা আমি শুনিনি।
এসব প্রসঙ্গে জানতে বৃহস্পতির রাতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ কে এম মীর হোসেনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি নিজের ব্যস্ততা দেখিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

দেশজুড়ে সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ