প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩০, ২০২২, ০১:৩০ এএম
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের ফলগাছা (সেনপাড়া) গ্রামের চিত্র এটি। সারা রাত মাসকলাইয়ের ডাল টেঁকিতে কিংবা জাঁতায় পিঁষে গুঁড়ো করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। রাত ৩টায় জেগে ওঠা। বাড়ির মহিলাদের টেঁকির শব্দে মুখরিত হয় গ্রাম। সঙ্গে যোগ দেন পুরুষ ও বাড়ির ছেলে-মেয়েরাও।
গ্রামজুড়ে প্রায় ৮০টি হি’ন্দু পরিবারের বসবাস। সে কারণে সেনপাড়া নামেও পরিচিত রয়েছে গ্রামটির। প্রতিদিন অর্ধ শতাধিক পরিবার ডালের বড়া তৈরি এবং তা বিক্রি করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করছেন। শীতকাল শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সেনপাড়ার প্রতিটি বাড়িতে চোখে পড়বে ডালের বড়া তৈরির এ দৃশ্য। শীত মৌসুমের সবজির সঙ্গে মুখরোচক খাবার হলো এই ডালের বড়া। সারাবছর কদর থাকলেও বড়ার চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে যায় শীতকালে।
এই গ্রামে মূলত মাসকলাইয়ের ডাল দিয়ে বড়া তৈরি হয়। ডালের সঙ্গে চালের আটা মিশিয়ে তৈরি হয় বড়া। শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে বড়া বানানোর কাজে লেগে যান সেনপাড়ার ৮০টি পরিবারের সব নারী-পুরুষ। তাদের সঙ্গে বাড়ির ছেলে-মেয়েরাও লেগে যায় বড়া তৈরির কাজে। সারারাত বালতি বা বড় পাতিলে মাসকলাই পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। এসব গুটি পাতলা কাপড় অথবা টিনের ওপরে রেখে রোদের তাপে শুকাতে হয়। রোদ ভালো হলে দুই দিনের মধ্যে খাওয়ার উপযোগী হয় বড়া। এরপর ঢেঁকি কিংবা জাঁতায় পিঁষে গুঁড়ো করেন তারা। পরে তা চালের আটার সঙ্গে মিশিয়ে ছোট ছোট গুটি করতে করেন।
জানা যায়, সেনপাড়ায় শুরুর দিকে তিন জনের মাধ্যমে বড়া বানানোর কাজ শুরু হয়। এখন ৮০টি পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস এই বড়া বিক্রির টাকা। যেহেতু বাড়ির সবাই মিলে এই কাজটি করতে পারেন তাই গ্রাম জুড়ে প্রতিটি পরিবারই এখন এ পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন। সেনপাড়া গ্রামের বড়া স্থানীয় হাট বাজার ছাড়াও জেলার গণ্ডি পেরিয়ে রংপুর, কুড়িগ্রাম, বগুড়া ও লালমনিরহাটসহ বিভিন্ন জেলায় পাইকারি বিক্রি হয়। এতে তাঁদের পরিবারে ফিরে এসেছে আর্থিক স্বচ্ছলতাও। ভালো মানের প্রতি কেজি বড়া ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়।
বড়া বানানোর কাজে ব্যস্ত বীরেন চন্দ্র সেন (৭৫)। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১ কেজি মাসকলাইয়ে এক কেজি বড়া হয় না। প্রতি কেজি ছাঁটা কালাইর দাম ১৬২ টাকা। সেই সঙ্গে অন্য জিনিসপত্রের যে দাম তাতে এখন আর বড়া বানিয়ে পোষায় না। বাড়তি লোক লাগে না পরিবারের সবাই মিলে কাজ করা যায় বলেই এখনো ধরে আছি। যা আয় হয় তাতে সংসার চলে মোটামুটিভাবে।’
বিনা রাণী (৪০) বলেন, ‘মাসকলাই পানিতে ভিজিয়ে রাখি। পরে রাত ৩টায় ঘুম থেকে উঠে কালাই ঢেঁকিতে গুঁড়া করে নেই। এরপর শুরু হয় ফেটানোর কাজ। এ কাজে সময় লাগে এবং পরিশ্রমও হয় খুব। ততক্ষণে আকাশে সূর্য উঠে যায়। এরপর সবাই মিলে লেগে যাই বড়া বানানোর কাজে। সেগুলো টিনের উপর সারিবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে রোদে শুকাতে হয়। ভালোভাবে শুকালেই বড়া খাওয়া যায়।’
বকুল চন্দ্র (৪০) বলেন, ‘স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে সবাই মিলে বড়া বানানোর কাজ করি। শুকানোর পর সেগুলো বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করি। ভালো মানের বড়া কেজি প্রতি ৩৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়। অন্য সময়ের চেয়ে শীতকালে বড়ার অনেক কদর। হাতে করে একাই আমি প্রত্যেক দিন গড়ে ৮/১০ কেজি করে বড়া বিক্রি করি।’
গাইবান্ধা সিভিল সার্জন ডা. মো. আব্দুল্লাহেল মাফী বলেন, ‘মাসকলাইয়ে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন রয়েছে। সবজির পাশাপাশি এসব ডালের বড়া স্বাস্থ্যর জন্য উপকারী। দেহ গঠনে ডালের বড়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’
