প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২, ২০২২, ০৫:৩৮ পিএম
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি আঘাত হানে। এরমধ্যে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ও নদী ভাঙন।
আগে ১৫ কিংবা ২০ বছর পর পর বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতি দুর্যোগ দেখা যেত। কিন্তু এখন তা প্রায় প্রতি বছর দেখা দিচ্ছে। এ কারণে উপকূলের মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। বর্তমানে উপকূলীয় এলাকার মানচিত্র বদলে জনপদের ভূমির পরিমাণ কমে নদীর সীমানা বেড়েছে। ভূগোল ও পরিবেশবিদরা মনে করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব এলাকা বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যার নমুনা ইতোমধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ ২০১৫-এর তথ্য অনুযায়ী বিগত ২৫ বছরে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় সংঘটনের হারের ক্রমবৃদ্ধি লক্ষ্যণীয়। বিগত ১৬ বছরে (১৯৯১-২০০৬) মাত্র ৬টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলেও গত এক দশকে (২০০৭-২০২০) সিডর, আইলা, মহাসেন, কোমেন, রোয়ান, বুলবুল, আম্পান ও ছিত্রাংসহ ১৪টি ঘূর্ণিঝড় ঘংঘটিত হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে এসব ঘূর্ণিঝড় আঘাত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তবতারই প্রতিফলন।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের নদীর বেড়িবাঁধ ভাঙার কারণে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কৃষিজমি, মাছের ঘের ও জনবসতি বিলীন হয়ে গেছে। নদীর সঙ্গে মিশে গেছে উপকূলীয় এ এলাকার বিস্তীর্ণ জনপদ। ভিটেবাড়ি হারিয়ে এখন প্রতাপনগর ছেড়ে খুলনার রূপসায় পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সময় নদীর বাঁধ ভেঙে দেড় বিঘা জমিসহ ঘরবাড়ি নদীতে চলে গেছে। কোনো চিহ্ন নেই। নিরুপায় হয়ে এলাকা ছেড়ে এখন খুলনায় বসবাস শুরু করেছি। এলাকায় থাকতে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়েছি। এখানে এসে ভ্যান চালাচ্ছি। জায়গা-জমি সব হারিয়েছি, যদি কোনো দিন এলাকায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ হয় সেদিন ফিরে যাব। ওই এলাকা এখন বসবাসের উপযোগী নয়।
প্রতাপনগর গ্রামের বাসিন্দা মিলন কুমার রুদ্র জানান, বারবার বেড়িবাঁধ ভাঙার ফলে এলাকার মানচিত্রের যে সীমারেখা, সেটা বিলুপ্তির পথে। ব্রিটিশ আমলের মানচিত্রের সঙ্গে বর্তমান চিত্র মেলে না। ব্রিটিশ আমলের সেই সীমারেখা এখন হারিয়ে গেছে। চাকলা, প্রতাপনগর, কুড়িকাওনিয়া, শ্রীপুর এ কয়েকটি গ্রামের মানচিত্রের সীমারেখা একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিবর্তন ঘটেছে। এ অবস্থায় পরিবেশ যদি চলতে থাকে, তবে ভবিষ্যতে প্রতাপনগর ইউনিয়নটি মানচিত্র থেকে হারিয়ে নদীগর্ভে বিলীন হবে।
প্রতাপনগর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (নায়েব) প্রশান্ত কুমার সরকার বলেন, ভূমির চিত্র পরিবর্তন হয়ে গেছে। এটা জরিপ কার্যক্রম চালিয়ে দেখব কতটুকু জমি নদীগর্ভে চলে গেল। প্রতি বছরই অব্যাহত নদীভাঙনের ফলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা চিঠি দেব। তিনি বলেন, আমি মনে করি ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে নদীভাঙনের কবলে পড়ে উপকূলীয় এলাকায় মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে। এটা নিয়ে জরিপ কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। কেননা আগের মানচিত্রের সঙ্গে এখনকার বাস্তব চিত্রের মিল নেই।
প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু দাউদ ঢালী বলেন, বাধঁ ভেঙে প্রতাপনগরের অনেক স্থান ডুবে ছিল দেড় বছরেরও বেশি সময়। বন্যতলা গ্রামে ১৩০টি পরিবার বসবাস করত। পরিবারগুলোর অধিকাংশ বাধ্য হয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। তবে কত সংখ্যক মানুষ চলে গেছে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। আর যারা আছে তাদেরকেও প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে। ভিটেবাড়ি হারিয়ে এখনো কয়েকটি পরিবার পরিষদের পাশে বাজারের মধ্যে খুপড়ি ঘড়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আ ন ম
গাউছার রেজা বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা সমস্যাসংকুল দ্বীপ ছিল
দক্ষিণ তালপট্টি ও পূর্বাশা দীপ। সেটি ইতোমধ্যে সমুদ্রতলে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক জনপদ হারিয়ে যাবে। যার প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে উপকূলীয় বিভিন্ন অঞ্চলে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও সমুদ্র সমতলের পানির উচ্চতা বেড়েছে। এগুলোর ফলে আমাদের দেশের বর্তমান যে মানচিত্র, সেটির একটা বড় পরিবর্তন হবে।
এএল/