প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২২, ০৭:৪৬ পিএম
আপন চাচার ছোড়া অ্যাসিডে ঝলছে গেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. আসাদ মন্ডলের মুখমন্ডলসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট (ঢাকা) থেকে এক মাস চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে তার ক্লাস শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। ভয় আর পুরোপুরি সুস্থ না হওয়ায় ক্লাসে যেতে পারছেন না আসাদ মন্ডল। সে কারণে ক্ষোভ আর দুঃখ প্রকাশ করেছেন আসাদ ও তার পরিবার।
অ্যাসিড দগ্ধ মো. আসাদ মন্ডল গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের উত্তর সাহাবাজ গ্রামের মো. ফিরোজ মন্ডলের ছেলে।
জানা যায়, ওই গ্রামের মৃত বাবর আলী মন্ডলের ছেলে ফিরোজ মন্ডল ও রাশেদুল ইসলাম ওরফে সুমন মন্ডলের জমি সংক্রান্ত বিরোধ ছিল। সে কারণে সুমন মন্ডল বিভিন্ন সময়ে ভয়ভীতি ও হুমকি দিতো ফিরোজ মন্ডল ও তার স্ত্রী সন্তানদের। এ অবস্থা চলাকালীন সময়ে বাবার রেখে যাওয়া টাকাকে কেন্দ্র করে মায়ের সাথে বিবাদ হয় রাশেদুলের। চরমে উঠলে রাশেদুলের বিরুদ্ধে মামলা করেন তার মা রোকেয়া বেগম। মামলায় ফিরোজের হাত আছে ভেবে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন রাশেদুল।
এরই জের ধরে সুমন মন্ডল গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভোরে ফিরোজ মন্ডলের ছেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসাদ মন্ডল ও সুন্দরগঞ্জ আব্দুল মজিদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তনু মন্ডলকে অ্যাসিড নিক্ষেপ করে পালিয়ে যান রাশেদুল ইসলাম ওরফে সুমন মন্ডল গংরা। এ ঘটনার পরদিন রাতে থানায় এজাহার দেন অ্যাসিড দগ্ধ দুই শিক্ষার্থীর মা মোছা. আনোয়ারা বেগম।
সম্প্রতি আসাদ মন্ডলের সঙ্গে কথা হয়। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, সহপাঠীরা ঘুরছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। আর আমি কাতরাচ্ছি অ্যাসিড নিক্ষেপের যন্ত্রণায়। বন্দি নিজ ঘরের চার দেয়ালে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু। যাওয়া হবে না। কি দুর্ভাগ্য আমার! স্বপ্নভঙ্গের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারছি না। সপ্তাহখানেক হয় চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছি।
আসাদ আরও বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে এবারে ভর্তি হয়েছি। ছোটবেলা থেকেই অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে বড় হয়েছি। অভাব-অনটনের মধ্যেও পড়ালেখা বন্ধ হতে দেয়নি বাবা-মা। এক পর্যায়ে দেশত্যাগ করে প্রবাস জীবনকে বেছে নেন বাবা। বাড়ি ছেড়ে উপজেলা শহরে বসবাস শুরু করেন মা। শুধুমাত্র পড়াশুনা করার জন্য। তাদের স্বপ্ন বুঝতে পারি এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা করে পড়াশুনা করতে থাকি। আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমতে এসএসসি ও এইচএসসিতে গোল্ডেন এ+ পেয়েছি। বাবা-মার স্বপ্ন পূরণে ছোটবেলা থেকে এত কষ্ট করে পড়াশুনা করলাম। সব থমকে যাচ্ছে মনে হয়। আমি আর পারছি না সহ্য করতে।
কথা হয় আসাদের মা মোছা. আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ছেলের বন্ধুরা ফোন করেছিল। উদ্বোধনী ক্লাস ডিসেম্বর মাসের এক তারিখে। কি করব বুঝতে পারছি না। নিজের বাড়িতেই নিরাপত্তা দিতে পারিনি ছেলেকে। বিশ্ববিদ্যালয় গেলে কে দেখে রাখবে তাকে। শত্রুরা তো আর বসে নেই।
আনোয়ারা বেগম আরও বলেন, জমি নিয়ে বিরোধ ছিল আমাদের মাঝে। ছেলেরা তো কোনো অন্যায় করেনি। কি কারণে তাদের শরীরে এসিড নিক্ষেপ করা হলো। আইনের আশ্রয়ও নিয়েছি। আসামি ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ তাদের ধরছে না। বুঝতে পারছি না কি আছে আমাদের কপালে। ছেলে পুরোপুরি সুস্থ না। এখনো সে চোখে কম দেখে। কানেও শোনে কম। জেগে থাকে সাড়া রাত, ঘুমাতেও পারে না। ঠিকমতো পারে না খেতেও। বাহিরে বের হতে ভয় পায়। সারাদিন ঘরেই শুয়ে-বসে থাকে। মনে হচ্ছে আমাদের স্বপ্ন আর কখনোই পুরণ হবে না।
অ্যাসিড দগ্ধ শিক্ষার্থীদের বাবা ফিরোজ মন্ডল বলেন, বাবার অসুস্থতার কথা শুনে দেশে আসি। অপারেশন করানোর মাসখানেক পরে তিনি মারা যান। মূলত বাবার চিকিৎসার ব্যয়ভারকে কেন্দ্র করেই দু’ভাইয়ের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এতে ইন্ধন দেন বোন জামাই। সর্বশেষ বন্ধকি এক জমিকে কেন্দ্র করে দু’ভাইয়ের মধ্যে মারামারি হয়। এতে ছোট ভাই আমার পরিবারের সবাইকে জড়িয়ে মামলা দেন। নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ভেবে মামলা করিনি। হয়তবা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হয়ে গেল উল্টোটা। যেটা আমি কখনো ভাবতে পারিনি। সে আমার ঘুমন্ত দুই ছেলেকে এসিড নিক্ষেপ করে। ছোট ছেলে এখন অনেকটা সুস্থ। কিন্তু বড় ছেলের বিপদ এখনো কাটেনি। প্রায় দেড় মাস চিকিৎসা শেষে চিকিৎসক বাড়িতে পাঠিয়েছেন। হাটা-চলা নিষেধ করেছেন। ক্যাম্পাসে যাওয়া তো দূরের কথা, পড়াশোনার কথা শুনলেই আঁতকে ওঠে। ভীষণ ভয় হচ্ছে না কি তার। মেধাবী ছাত্র হওয়াটাই যেন তার কাল হয়ে গেল।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বামনডাঙ্গা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ মো. শফিকুজ্জামান সরকার বলেন, আসামি ধরতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুত সময়ে এর একটা রেজাল্ট পাবো।
এএল/