প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২২, ১০:০৭ পিএম
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকলটি প্রায় দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। এ চিনিকলের স্থায়ী চাকরিজীবীদের একাংশ, গাড়ি, যন্ত্রাংশ ও নানা প্রয়োজনীয় মালামাল সরিয়ে নেয়া হয়েছে অন্যত্র। যার কারণে কর্মচারী-শ্রমিকসহ লক্ষাধিক আখ চাষির থমকে গেছে জীবন-জীবিকা।
জানা যায়, ওই চিনিকলটির লোকসান কমাতে আধুনিকায়নের মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার কথা বলে বিগত ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন ১৫টির মধ্যে যে ৬টি চিনিকলে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করে। এর মধ্যে অন্যতম রাষ্ট্রায়াত্ত এ চিনিকলটি। শ্রমিক-কর্মচারী ও চাষিদের উদ্দেশ্যে দেশের প্রায় সকল জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছিল, আধুনিকায়ণের মাধ্যমে খুব দ্রুতই আবার চালু করা হবে এই চিনিকলসহ সকল চিনিকল। কিন্তু চিনিকলটি চালু হয়নি আজও।
কাজ হারানো ‘কাজ নাই, মজুরী নাই (কানামনা) চুক্তিভিত্তিক অর্ধসহ শতাধিক শ্রমিকরা এখন পেটের দায়ে ভ্যান-রিকশা চালনাসহ বিভিন্ন কাজ করে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্যদিকে চালু রাখা পাশ্ববর্তী চিনিকলের চাইতে অধিক মাড়াই ক্ষমতাসম্পন্ন ও অধিক পরিমাণ আখ উৎপাদিত হলেও রহস্যজনক কারণে এ কলটি বন্ধ করায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন এলাকার হাজার হাজার আখচাষিসহ সাধারণ মানুষ।
গত দুই বছর বন্ধ থাকায় ৩৫ একর আয়তনের কারখানা চত্বর ভরে গেছে জঙ্গলে। এই দৃশ্য দেখলে মানুষের সরব উপস্থিতির অভাব নিশ্চিত হওয়া যায় খুব সহজে। খোলা আকাশের নীচে অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা আখ পরিবহনের যানবাহনগুলো ধ্বংসের পথে। কারখানার ভেতরের দৃশ্যটাও একই রকম। কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতিতে এখন মরিচার রাজত্ব। থমকে আছে জীবিকার চাকাগুলো। আখচাষি আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিত্যদিনের সমাবেশের চিরচেনা দৃশ্য আর নেই। হাজারো মানুষের একসময়ের জীবন-জীবিকার কেন্দ্রস্থলের প্রবেশপথ ও মিলে সরবরাহের জন্য সারিবদ্ধ গাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণটি এখন গো-চারণভূমি।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত শতাব্দীর ৯০ এর দশকে তৎকালীন এরশাদ সরকারের শাসনামলে আধুনিকায়ণের নামে কর্মকর্তাদের জন্য দামি গাড়ি-বাড়ি, এ্যাম্বুলেন্স ও কারখানার কিছু সংস্কারের জন্য বিশ্ব ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেয়া হয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থার আওতাধীন চিনিকলগুলোকে। এসব ঋণ এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে চিনিকলগুলোর। রংপুর চিনিকলের বর্তমানে ৫০০ কোটি টাকা পুঞ্জিভূত লোকসানের প্রধান কারণ বিশ্বব্যাংকের এই ঋণ বলে অভিযোগ করেছেন তারা।
মিলস গেট সাবজোনের আখচাষি ফেরদৌস আলম অভিযোগ করে বলেন, `রংপুর চিনিকলের চেয়ে অনেক কম মাড়াই ক্ষমতাসম্পন্ন জয়পুরহাট চিনিকলের আখ জোন এলাকায় আখও উৎপাদন হয় কয়েক গুণ কম। তারপরও ওই মিলটি চালু রেখে ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের রংপুর চিনিকলের আখ এবং ১০০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরের শ্যামপুর চিনিকলের আখ জয়পুরহাটে পরিবহন করতে অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা। জয়পুরহাট ও শ্যামপুরের মধ্যবর্তী স্থানের রংপুর চিনিকলটি চালু রাখলে সরকারকে এই অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করতে হতো না।`
রংপুর চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক ফারুক হোসেন ফটু বলেন, `দেশের কৃষক-শ্রমিক স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে রাষ্ট্রায়াত্ত চিনিশিল্প বন্ধ করে দেয়ার গভীর চক্রান্ত চলছে। চিনিকলটি বন্ধ থাকায় অর্থনৈতিকসহ এই জনপদের সকল স্তরে অন্ধকার নেমে এসেছে। বর্তমানের কৃষক ও শ্রমিকবান্ধব এ সরকার অসাধু সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রের এই জাল ছিন্ন করে পূনরায় চিনিকলটি আধুনিকায়নের মাধ্যমে চালু করার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।`
রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূরুল কবির বলেন, `চালু অবস্থায় এ চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের জন্য বেতন-ভাতা বাবদ মাসে প্রায় এক কোটি টাকা প্রয়োজন হতো। সরকারি সিদ্ধান্তে মাড়াই বন্ধ হওয়া এ চিনিকলের বিপুল পরিমাণ সম্পদ রক্ষায় বর্তমানে ২৬ জন স্থায়ী কর্মকর্তা ও ৬২ জন অস্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন ভাতা ২০ লাখ টাকা।`
এএল/