• ঢাকা শুক্রবার
    ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

পঞ্চগড়ে নৌকাডুবিতে নিহত বেড়ে ৫০, চলছে শোকের মাতম

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২, ০১:৪১ এএম

পঞ্চগড়ে নৌকাডুবিতে নিহত বেড়ে ৫০, চলছে শোকের মাতম

দেশজুড়ে ডেস্ক

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৭ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। এ ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন আরও অনেকে। আউলিয়ার ঘাটে নদীর তীরে চলছে শোকের মাতম। স্বজনদের বাঁধ ভাঙা কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে আকাশ বাতাস। নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ ও হতাহতদের সন্ধানে ভিড় করছেন স্বজনরা।

ঘটনার পর পর ঘটনাস্থল উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় শত শত মানুষ ভিড় করেন। এদের মধ্যে হতাহতদের অনেক স্বজন আছেন। নদীর পাড়ে চলছে স্বজনদের আহজারি। তাদের কান্নায় নদীর পাড়ে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য তৈরি হয়েছে। আশপাশের পরিবেশ হয়ে উঠেছে ভারি। কেউ বোনের মরদেহের সামনে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদেন। কেউ আবার ভাইয়ের মরদেহের সামনে মাতম করছেন। কেউ কেউ নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছুটছেন। আউলিয়া ঘাট এলাকার করতোয়া পাড়ে স্বজন হারানোর এই বিলাপে চোখের জল ধরে রাখতে পারছেন কেউ।

স্থানীয়রা জানান, ধারণ ক্ষমতার বাহিরে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি শতাধিক যাত্রী নিয়ে আউলিয়া ঘাট থেকে বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরে (নদীর অপরপাড়ে) যাচ্ছিল। যাত্রীদের অধিকাংশ সনাতন ধর্মের অনুসারী। তারা শারদীয় দুর্গোৎসবের মহালয়া উপলক্ষে ওই মন্দিরে যাচ্ছিলেন। তিন গুণের বেশি যাত্রী নিয়ে যাত্রার কিছুদূর যাওয়ার পরই দুই দিকে দুলতে থাকে নৌকাটি। এ সময় মাঝি নৌকাটি তীরে ভেড়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। আতঙ্কিত যাত্রীদের হুড়াহুড়িতে নৌকাটি ডুবে যায়।

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের ফুটকিবাড়ি আরাজি শিকারপুর গ্রামের বাংঠু রামের মেজো ছেলে হেমন্ত রায়ের স্ত্রী কবিতা (৪৫), তার মেয়ে কলি রায় শ্যামলী (১৪), ছোট ভাই বাসুদেব স্ত্রী রুপালী রানী (৩৫), হেমন্ত রায়ের নাতনী জয়া রানী (৭) জয়শ্রী (৩), আলো রানী (৩০) অর্পিতা রানী (১৭), বাসুদেবের মেয়ে নন্দনী (৮) সহ আটজন গেলেও তার মধ্যে অর্পিতা ও আলো সাতার কেটে ফিরে আসেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন নন্দনী আর কবিতা, শ্যামলী ও রুপালি রানীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। বাকি ধীরেন রায়ের মেয়ে জয়শ্রী ও জয়া রানী এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। পরিবারের তিনজনের মৃত্যুতে ও দুই শিশু কন্যার নিখোঁজে পুরোগ্রাম জুড়ে শোকের মাতল। তাদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।

স্ত্রী ও দুই নাতনীকে হারিয়ে পাগল প্রায় হেমন্ত রায়। তিনি জানান, রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে আমার স্ত্রী, তিন মেয়ে, দুই নাতনি ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রী, কন্যা মহালয়া উপলক্ষে বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরে ধর্মসভায় যোগ দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হন। মাড়েয়া ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাটে করতোয়া নদী নৌকায় করে পার হওয়ার সময় নৌকা ডুবে ২৫ জন মারা যান। আমার পরিবারের আট জন্যই গভীর পানিতে তলিয়ে যায়। দুই মেয়ে সাঁতার কেটে ফিরে আসে। ছোট ভাইয়ের মেয়ে চিকিৎসাধীন, তিনজনের লাশ পেয়েছি আর দুইজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। এ ঘটনা মেনে নেয়ার মতো না। আমার ফুটফুটে দুই নাতনিকে এখনো পাওয়া যায়নি। নাতনিকে উদ্ধারের জন্য প্রশাসনকে অনুরোধ জানান তিনি।

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাট এলাকায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া যাত্রী মাড়েয়া বামনপাড়া এলাকার সুবাস চন্দ্র রায় বলেন, আমরা পাঁচজন বন্ধু ছিলাম। কোনমতে সাতার কেটে প্রাণে বেঁচে যাই।

তিনি আরও বলেন, আমিও নৌকায় ছিলাম। নৌকায় দেড়শরও বেশি যাত্রী ছিল। আমরা নৌকায় উঠার পরপরই নৌকায় পানি ঢুকতে শুরু করে। এ সময় মানুষজন নৌকার মধ্যেই হুড়োহুড়ি শুরু করেন। পরে যে পাশেই যাচ্ছিলাম, সে পাশেই নৌকায় পানি ঢুকছিল।

সুবাস চন্দ্র বলেন, অন্য যাত্রীরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার আকুতি করছিল। কিন্তু চরম মুহূর্তের বর্ণনা করতে পারবো না। তবে এতো মানুষ মারা যাবেন, তা বুঝতে পারিনি।

ষাটোর্ধ কৃষ্ণ চন্দ্র রায় ভাই এবং ভাইপোর খোঁজে এসেছেন আউলিয়া ঘাটে। তিনি জানান, নদীর অপরপাড়ে বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া পূজায় যোগ দিতে তার ভাই নরেশ ও ভাইপো সিন্টু বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরেননি। নৌকাডুবির খবরে কাল থেকেই এখানে লাশের অপেক্ষা করছেন তিনি।

নাতির খোঁজে উপজেলার পাঁচপীর এলাকা থেকে এসেছেন বৃদ্ধ সুমল চন্দ্র। তিনি বলেন, নাতির মরদেহটা পেলে অন্তত নিজেরা সৎকারের কাজটা করতে পারতাম।

মাড়েয়া বটতলি এলাকার ধীরেন বাবুর দুই প্রতিবেশীসহ ৭ জন নিকটাত্মীয় এখনো নিখোঁজ। কাল থেকে তিনি নদীর পাড়ে অপেক্ষা করছেন। তিনি বলেন, বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া পূজায় যোগ দিতে আমার ভাতিজা, ভাতিজার বউ, ভাতিজার শ্বশুর, শ্যালিকা এবং আমার ভাতিজি নৌকায় ওঠে দুর্ঘটনায় পড়েন। এখন পর্যন্ত কারো খোঁজ পাইনি। এখন তাদের লাশের অপেক্ষা করতেছি।

এলাকাবাসী জানায়, ওই নদীতে কোনো সেতু না থাকায় রোববার দুপুরের দিকে ধর্মসভায় যোগ দিতে শতাধিক যাত্রী একটি মাত্র নৌকাযোগে করতোয়া নদী পার হচ্ছিল। অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে নদীর মাঝপথে নৌকাটি ডুবে যায়। অনেকে সাঁতার জানায় তীরে আসতে পারলেও সাঁতার না জানা বিশেষ করে নারী ও শিশুরা পানিতে ডুবে যায়।

দেবীগঞ্জ উপজেলার ৬নং মাড়েয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু আনশার মো. রেজাউল করিম শামীম জানান, একই পরিবারের ৮ জনের মধ্যে দুইজন ফিরে এসেছে। তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আরো ২ জন নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজদের উদ্ধারে ডুবুরি দল কাজ করছে। জেলা প্রশাসকের পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ওই পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা করা হবে বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, নৌকাডুবি ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারগুলোকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।

জেডআই/

আর্কাইভ