প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২২, ০২:৪০ এএম
সাত বছর আগে ২০১৫ সালে এসআরও জারির মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে ম্যানেজিং কমিটির ক্ষমতা খর্ব করা হয়। এরপর থেকে এনটিআরসিএ`র মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু সরকারি সেই নির্দেশনা অমান্য করে একটি কলেজের জন্য স্বয়ং সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে এমন খবরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা সেখানে উপস্থিত হন। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে নিয়োগ বোর্ডের প্রধান সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজের অধ্যক্ষ চিন্ময় বাড়ৈ পরীক্ষা স্থগিত করতে বাধ্য হন।
বুধবার (১৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজে মিঠাপুকুর উপজেলার শুকুরেরহাট ডিগ্রি কলেজে প্রভাষক পদের ওই নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিঠাপুকুর উপজেলার শুকুরেরহাট কলেজ থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দুরে অধ্যক্ষ চিন্ময় বাড়ৈ তার নিজ প্রতিষ্ঠান সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজে অতি গোপনে ওই নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিতে নিজেই নিয়োগ বোর্ডের ডিজির (মাউশির মহাপরিচালক) প্রতিনিধি হিসেবে অধ্যক্ষ চিন্ময় বাড়ৈ এ আয়োজন করেন বলে অভিযোগ ওঠে। বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে অধ্যক্ষ চিন্ময় বাড়ৈ বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন (বিষয়ের বিশেষজ্ঞ) শিক্ষক লিখিত পরীক্ষা কেন্দ্রের কক্ষ ছেড়ে সটকে পড়েন।
এদিকে বুধবার ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক (পাস) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ইসলাম শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন বিষয়ের পরীক্ষা। এ কারণে প্রশাসন কর্তৃক সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্রের আশপাশে ১৪৪ ধারা জারি করা ছিল। অথচ আইনের প্রতি তোয়াক্কা না করে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অতি গোপনে অধ্যক্ষ চিন্ময় বাড়ৈ ওই নিয়োগ পরীক্ষার আয়োজন করার ঘটনায় অভিভাবক ও সচেতন মহলে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষক নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা আছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক অসিউজ্জামান, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক শায়খুল ইসলাম মামুন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ড. মো. আরিফুর রহমান, দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসনিম নাজিরা রিদা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহমুদুর রহমান।
প্রসঙ্গত, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর এসআরও জারির মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্ব খর্ব করা হয়। ওই তারিখের পর থেকে কোন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারবে না। এরপর থেকে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ দিবে বলে নির্দেশ জারি করে। এমন সরকারি বিধি নিষেধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে অতি গোপনে পূর্বের দিন ও তারিখ দেখিয়ে মিঠাপুকুরের শুকুরেরহাট কলেজের অধ্যক্ষ ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি ওই নিয়োগ পরীক্ষার আয়োজন করেন। আর এতে ডিজির প্রতিনিধি হিসেবে সকল আয়োজন সম্পন্ন করাসহ নিয়োগ প্রক্রিয়া জায়েজ করার দায়িত্ব নেন সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজের অধ্যক্ষ চিন্ময় বাড়ৈ। উক্ত নিয়োগ বোর্ডের অন্যান্য সদস্যরা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয় একজন প্রতিনিধি (বিষয় বিশেষজ্ঞ), কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি, গর্ভনিংবডির সদস্য ও সংশ্লিষ্ট কলেজের অধ্যক্ষ।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, একটি পত্রিকায় গোপনে মিঠাপুকুর উপজেলার শুকুরেরহাট ডিগ্রি কলেজের ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, ইসলামে ইতিহাস ও সংস্কৃতি ও দর্শন বিভাগের প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর সরকার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সংক্রান্ত এসআরও (সংবিধিবদ্ধ নিয়ম ও আদেশ) জারি করে। যাতে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের ইচ্ছে মত অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে না পারে। এ কারণে এনটিআরসিএ মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের নিয়োগদানের ক্ষমতা খর্ব হয়ে পড়ে। কিন্তু এত কিছুর পরেও শুকুরেরহাট কলেজ কর্তৃপক্ষ অধ্যক্ষ চিন্ময় বাড়ৈ’র পরামর্শে অতি গোপনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা না নিয়ে সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজে ওই পরীক্ষার আয়োজন করেন।
কলেজের কয়েকজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ৫জন প্রার্থীকে নিয়োগ চূড়ান্ত করার জন্য বেগম রোকেয়া কলেজের অধ্যক্ষ চিস্ময় বাড়ৈ সংশ্লিষ্ট কলেজ অধ্যক্ষের মাধ্যমে একাই ১০ লাখ টাকা নেওয়ার চুক্তি করেন। সে কারণে বেগম রোকেয়া কলেজে ওই পরীক্ষা নেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়। অথচ বুধবার ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে স্নাতক পাস তৃতীয় বর্ষের ইসলাম শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ের পরীক্ষা। এ কারণে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে ১৪৪ ধারা জারি ছিল। অথচ আইনের কোন তোয়াক্কা না করে নিজের পকেট ভারী করতে বিভাগীয় শহরে সকল প্রকার প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অতি গোপনে অধ্যক্ষ চিন্ময় বাড়ৈ ওই নিয়োগ পরীক্ষার আয়োজন করেন।
অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে বেগম রোকেয়া কলেজের অধ্যক্ষ চিন্ময় বাড়ৈ বলেন, বৈধভাবেই নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ আমার কাছে বিষয়গুলো গোপন করেন। যেহেতু নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলো। এসব কারণে পরীক্ষার পুরো প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়েছে।
বৈধভাবে পরীক্ষা নেওয়ার প্রক্রিয়া ছিল কিনা এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসনিম নাজিরা রিদা বলেন, ‘আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দিতে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে দেখি পরিস্থিতি ভিন্ন। নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এখনও রোকেয়া কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে আছি। বিস্তারিত জানতে হলে সরাসরি এসে কথা বলেন।’
শুকুরেরহাট ডিগ্রি কলেজের (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যক্ষ গোলজার হোসেন বলেন, ‘নিয়োগ কার্যক্রম চলার সময় সাংবাদিকরা হঠাৎ করে সেখানে হাজির হন। এমন পরিস্থিতে নিয়োগ কার্যক্রম ভন্ডুল হয়। নিয়োগ বাতিল হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।’
কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি সেলিম মণ্ডল বলেন, ‘নিয়োগের অভ্যন্তরীন বিষয়গুলো অধ্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ করেন। আমাকে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য মনোনীত করলে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। তবে লোকজনের উপস্থিতিতে বেগম রোকেয়া কলেজের অধ্যক্ষ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।’
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মো. আব্দুল মতিন লষ্কর বলেন, ‘২০১৫ সালের পর থেকে কোন বেসরকারি কলেজ কর্তৃপক্ষ কোন শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারবে না। এখন কি উদ্দেশ্য নিয়ে ওই নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছিল তা আমার জানা নেই। তবে জেলা অতিরিক্তি জেলা প্রশাসকের (শিক্ষা) দপ্তর থেকে বিষয়টি অবগত করার জন্য আমাকে জানানো হয়। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
এআরআই