• ঢাকা মঙ্গলবার
    ০৪ মার্চ, ২০২৫, ২০ ফাল্গুন ১৪৩১

যে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর থেকে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা দ্বিগুণ!

প্রকাশিত: জুলাই ২৫, ২০২২, ১১:০০ পিএম

যে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর থেকে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা দ্বিগুণ!

হাসান আল সাকিব, রংপুর ব্যুরো

ঘড়ির কাটায় বেলা ১২টা। ষষ্ঠ শ্রেণিতে বসে আছে চারজন শিক্ষার্থী। সপ্তম শ্রেণিতে উঁকি দিয়ে দেখা গেল একজন শিক্ষার্থীও নেই। অষ্টম শ্রেণিতে তিনজন থাকলেও নবম শ্রেণিতে একজনও উপস্থিত নেই। দশম শ্রেণিতে দুই শিক্ষার্থীকে খোশগল্প করতে দেখা যায়।

বিদ্যালয়টিতে কাগজে-কলমে ভর্তি আছে ৫৫ জন শিক্ষার্থী। কিন্তু প্রতিদিনকার উপস্থিতি একেবারেই কম। অথচ শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন ১৮ জন। বিদ্যালয়টির ফটকে নাম লেখা না থাকায় এটি যে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, তা বুঝতেই অনেক সময় লেগে যাবে। বিদ্যালয় মাঠে যেমন কোনো গাছপালা নেই, তেমন বিদ্যালয়টিকে কেন্দ্র করে কোনো কোলাহলও নেই। এমনই একটি বিদ্যালয় রংপুরের পীরগাছার পাঠক শিকড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।

সোমবার (২৫ জুলাই) দুপুরে সরেজমিনে বিদ্যালয়টিতে গিয়ে এ চিত্র দেখা যায়।

জানা গেছে, ১৯৮৯ সালে নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের প্রচেষ্টায় পাঠক শিকড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার শুরুতে বিদ্যালয়টি সুনামের সহিত পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করে আশপাশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু বিদ্যালয়টিতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে বিধান চন্দ্র রায় যোগদানের পর থেকে শিক্ষার মান নিম্নমুখী হতে থাকে। তিনি শুরু থেকে বিদ্যালয় পরিচালনায় গোপনে পকেট কমিটি গঠন করে আসছেন। গঠিত কমিটি তার নিয়ন্ত্রণে থাকায় তিনি বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিদ্যালয় পরিচালনা করছেন। তার অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করলে শিক্ষা বোর্ডে আবেদন করে সেই ম্যানেজিং কমিটি ভেঙে দেন। কিছুদিন এডহক কমিটি দিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা করে ফের গোপনে নতুন কমিটি গঠন করেন। তার বিরুদ্ধে ম্যানেজিং কমিটির স্বাক্ষর জাল করে শিক্ষক নিয়োগ, বিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাতসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। তিনি বিদ্যালয়ে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকেন। বিদ্যালয়ের পিয়ন তার বাড়িতে গিয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর নিয়ে আসেন। ফলে বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা ভেস্তে যেতে বসেছে।

সর্বশেষ কমিটি গঠনেও অনিয়ম
সর্বশেষ গত মার্চ মাসে আবারও গোপনে ম্যানেজিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি গঠনের বিষয়টি অভিভাবকসহ এলাকাবাসীকে জানানো হয়নি। গত জুন মাসের শেষ সপ্তাহে গোপনে কমিটি গঠনের বিষয়টি ফাঁস হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ম্যানেজিং কমিটি গঠনের লক্ষ্যে ২৮ ফেব্রুয়ারি উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার ফারুকুজ্জামান ডাকুয়াকে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। তিনি নিয়োগ পেয়ে সে দিনই তফসিল ঘোষণা করেন। এমনকি বিদ্যালয়ে না গিয়ে সে দিনই প্রচারণার কথা বলা হয়। তফসিল অনুযায়ী, ১৫ মার্চ চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের কথা থাকলেও ১৩ মার্চেই প্রকাশ করা হয়। অথচ ১৪ মার্চ ছিল মনোনয়ন প্রত্যাহারের নির্ধারিত তারিখ। শুধু তাই নয়, কমিটিতে যাদের অভিভাবক সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে তারাসহ এলাকাবাসী ও অন্য অভিভাবকরা কমিটি গঠনের আগে বিষয়টি জানতেন না। এমনকি এডহক কমিটির সভাপতিকেও জানানো হয়নি।

প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ও উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার ফারুকুজ্জামান ডাকুয়া মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে গোপনে অবৈধভাবে ম্যানেজিং কমিটি গঠনে প্রধান শিক্ষক বিধান চন্দ্র রায়কে সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এর আগেও তিনি অর্থের বিনিময়ে প্রধান শিক্ষককে অবৈধভাবে কমিটি গঠনসহ নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন।

বিদ্যালয়ের সর্বশেষ এডহক কমিটির সভাপতি রেজাউল করিম লিটন বলেন, ’আমি এডহক কমিটির সভাপতি হলেও নিয়মিত ম্যানেজিং কমিটি গঠনের বিষয়ে আমাকে কিছু জানানো হয়নি। প্রধান শিক্ষক গোপনে কমিটি গঠন করে অভিভাবক ও এলাকাবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।’

বিদ্যালয়ে আসেন না প্রধান শিক্ষক:

প্রধান শিক্ষক বিধান চন্দ্র রায় নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেন না। তবে হাজিরা খাতায় তার নিয়মিত উপস্থিতির স্বাক্ষর করা হয়। এ জন্য বিদ্যালয়ের পিয়ন তার বাড়িতে হাজিরা খাতা নিয়ে গিয়ে স্বাক্ষর করে আনেন। বিদ্যালয়ে না আসার বিষয়ে স্থানীয় শিক্ষা দফতরসহ একাধিক দফতরে অভিযোগ করেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সর্বশেষ অবৈধভাবে গোপনে কমিটি করার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে বিদ্যালয়ে আসা ছেড়ে দেন প্রধান শিক্ষক। বিষয়টি জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী। এ ঘটনায় প্রধান শিক্ষক ক্ষিপ্ত হয়ে এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে উল্টো অভিযোগ দায়ের করেন।

প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতির সহযোগী একাডেমিক সুপারভাইজার
২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর এসআরও জারির মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে ম্যানেজিং কমিটির ক্ষমতা খর্ব করা হয়। কিন্তু প্রধান শিক্ষক পরিপত্র জারির পূর্বের তারিখ দেখিয়ে ম্যানেজিং কমিটি ছাড়াই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে গোপনে শিক্ষক নিয়োগ দেন। পরবর্তীতে বিপুল চন্দ্র বর্ম্মন নামে ওই সহকারী শিক্ষক এমপিওভুক্তও হন। যার ইনডেক্স নং ১১৪৪০৭৬। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে এমপিওভুক্তির পর বিষয়টি নজরে আসে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিসহ সকলের। এ বিষয়ে সভাপতি একাধিক দফতরে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার ফারুকুজ্জামান ডাকুয়াকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি বিদ্যালয়ে গিয়ে তদন্তকালে ঘটনার সত্যতা পান। অপরদিকে, প্রধান শিক্ষক নিজেকে বাঁচাতে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে আবেদন করে ম্যানেজিং কমিটি ভেঙে দেন।  এ সুযোগে একাডেমিক সুপারভাইজার মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেন বলে অভিযোগ করেছেন সর্বশেষ ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এমদাদুল হক। 

পীরগাছা উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার ফারুকুজ্জামান ডাকুয়া ও পাঠক শিকড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিধান চন্দ্র রায়ের বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ফলগাছা গ্রামে। পাশের উপজেলা হওয়ায় ফারুকুজ্জামান ডাকুয়া দীর্ঘদিন থেকে পীরগাছাতেই চাকরি করছেন। আর একই গ্রামে বাড়ি হওয়ায় প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতির ছায়াসঙ্গী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন একাডেমিক সুপারভাইজার। তাদের অপ্রতিরোধ্য অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা ভেস্তে যেতে বসেছে।

এমদাদুল হক বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক ম্যানেজিং কমিটি ছাড়াই অবৈধভাবে একজন শিক্ষক নিয়োগ দেন। আমরা সংশ্লিষ্ট একাধিক দফতরে অভিযোগ করি। কিন্তু একাডেমিক সুপারভাইজার মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়ে ওই শিক্ষকের বেতনভাতা উত্তোলনের ব্যবস্থা করে দেন।’

অতিষ্ঠ অভিভাবকরা মেয়েদের পাঠান অন্য বিদ্যালয়ে:

প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে একাধিক দফতরে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার না পাওয়ায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন অভিভাবকরা। তারা এখন নিরব প্রতিবাদ হিসেবে নিজেদের সন্তানকে অন্য বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। ফলে একসময়ে বিদ্যালয়টিতে শত শত শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকলেও বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৯ জনে নেমে এসেছে। যেখানে বিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারি রয়েছেন ১৮ জন।

অভিভাবক রুবেল ইসলাম বলেন, ’আমার মেয়ে এই বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতো। কিন্তু এই বিদ্যালয়ে পড়াশুনার চেয়ে রাজনীতি বেশি চলে। প্রধান শিক্ষক নিজে দুর্নীতিবাজ, শিক্ষকরা যে যার মতো চলে। তাই আমার মেয়েকে অন্য বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছি।’

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস ছালাম বলেন, ’বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা ভেস্তে গেছে। প্রধান শিক্ষক নিজ খেয়াল খুশিমতো বিদ্যালয় পরিচালনা করেন। তার দুর্নীতির প্রতিবাদ করলে কমিটি ভেঙে দেন। কোথাও অভিযোগ করে ফল পাওয়া যায় না। টাকার জোরে প্রধান শিক্ষক সবকিছু ধামাচাপা দেন।

অভিযোগের নেওয়া হয় না ব্যবস্থা:

বিভিন্ন সময়ে প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে একাধিক দফতরে অভিযোগ করলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সর্বশেষ গঠিত অবৈধ ম্যানেজিং কমিটি তদন্তপূর্বক বাতিল চেয়ে পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, রংপুর জেলা শিক্ষা অফিসার ও দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ করা হয়। কিন্তু গত এক মাসেও অজ্ঞাত কারণে সেই অভিযোগের তদন্ত করা হয়নি। এতে ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও এলাকাবাসীর মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

অবৈধ কমিটি দিয়ে নিয়োগ বাণিজ্যের চেষ্টা
অবৈধভাবে গঠিত কমিটি দিয়ে বিদ্যালয়ে কর্মচারী নিয়োগের নামে আবারও নিয়োগ বাণিজ্য শুরু করেছেন প্রধান শিক্ষক। কর্মচারী নিয়োগের জন্য ডোনেশনের নামে মোটা অংকের টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আর এই টাকা দিয়েই সব পক্ষকে ম্যানেজ করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন প্রধান শিক্ষক।

এ বিষয়ে অবৈধভাবে গঠিত কমিটি দিয়ে বিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধের জন্য রংপুর জেলা শিক্ষা অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক দফতরে লিখিত অভিযোগ করেছেন অভিভাবক ও এলাকাবাসী।

পাঠক শিকড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিধান চন্দ্র রায় বলেন, ‘বেসরকারি স্কুল কলেজে ম্যানেজিং কমিটি এভাবেই সকলকে ম্যানেজ করে গঠিত হয়। অনিয়ম হয়ে থাকলে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।’

এ বিষয়ে উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার ফারুকুজ্জামান ডাকুয়া বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রচারণার দায়িত্ব প্রধান শিক্ষকের।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ শামসুল আরেফীন বলেন, ‘গোপনে ম্যানেজিং কমিটি গঠনের বিষয়ে একটি অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘বিদ্যালয়ের অভিভাবক ও এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন। তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জেইউ/এএল

আর্কাইভ