• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ০৭ নভেম্বর, ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

ছয় নয় প্রকল্পে কোটি টাকা লোপাটের আয়োজন, অডিও ক্লিপে গোমর ফাঁস!

প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০২২, ০৭:৪৪ এএম

ছয় নয় প্রকল্পে কোটি টাকা লোপাটের আয়োজন,  অডিও ক্লিপে গোমর ফাঁস!

হাসান আল সাকিব, রংপুর ব্যুরো

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্পের আওতায় ৬শ ৪০ শিক্ষক-সুপারভাইজারের ৬ মাসের বেতন ৯৪ লাখ ৫৬ হাজার টাকা সরাসরি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এনজিও ন্যাশনাল এজেন্সি ফর গ্রীণ রেভুলেশন- নগরের একাউন্টে দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো।

তবে সরকারের দেওয়া এ টাকার বড় একটি অংশ লোপাট করে নগর নামে এ এনজিও। তবে এ সংক্রান্ত একটি অডিও ফাঁসের পর লুণ্ঠিত টাকা গলার ফাঁসে পরিণত হয়েছে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা  নামে ওই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্প (৬৪ জেলা) -এর আওতায় কাউনিয়ায় ৬৪০টি স্কুলের মেয়াদ শেষ হয় গত জুন মাসে। জুন ক্লোজিং-এর শেষ দিন প্রকল্পের ৬শ ৪০ জন শিক্ষক-সুপারভাইজারের ৬ মাসের বেতন ৯৪ লাখ ৫৬ হাজার টাকা ছাড় করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো।  ২৬ জুন ২০২২ তারিখ এনজিও নগরের নির্বাহী পরিচালক মোজাফ্ফর আহমেদ, প্রকল্প পরিচালক শাহেদুল হক এবং প্রকল্প কর্মকর্তা মো. জাকারিয়ার স্বাক্ষর করা মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সিডিবি ৩৯৬৫৫৩৫ চেকের মাধ্যমে স্বাক্ষরিত একটি চেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অ্যাকাউন্টে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু একই ব্যাক্তিদের ৪ জুলাই স্বাক্ষর করা একই ব্যাংকের সিডিবি ৩৯৬৫৫৩৭ আরেকটি চেকের মাধ্যমে ৭৪ লাখ ৫৬ হাজার টাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অ্যাকাউন্টে প্রেরণ করেন। 

 

এনজিও নগরের চিফ প্রজেক্ট ভিজিটর ও স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা মাহমুদুল হাসান পিন্টু দ্বিতীয় চেকের টাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অ্যাকান্টে জমা করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার একান্ত সহকারী ফারুক হোসেনের কাছে দেন। কিন্তু এই চেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিনা তারিন গ্রহণ করেননি। এরইমধ্যে প্রকল্পের সুপারভাইজার ও শিক্ষকরা মূল টাকা থেকে ২০ লাখ টাকা কম প্রেরণের বিষয়টি জানতে পেরে নিজেদের মধ্যে এর প্রতিবাদ শুরু করেন। 

 


 

চিফ প্রজেক্ট ভিজিটর মাহমুদুল হাসান পিন্টু প্রকল্পের একটি হোয়ার্টসঅ্যাপ গ্রুপে অন্যান্যদের সঙ্গে অডিও কলে কথা বলেন। তিনি জানান, প্রকল্পের কাগজপত্রে দুর্বলতার কারণে ২০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন সকলের সঙ্গে কথা বলে ঘুষ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবিও করেন পিন্টু। পিন্টুর এই কথোপকথনের একটি অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে প্রকল্পের প্রায় কোটি টাকা লোপাটের পুরো আয়োজন প্রকাশ হয়ে পড়ে। 

 

এদিকে রবিবার (১৭ জুলাই) ওই উপজেলার  ৬শ ৪০টি স্কুলের খোঁজে নামে সিটি নিউজ ঢাকা। এসময় কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে একটি মাত্র স্কুলে একটি প্যানাফ্লেক্স ব্যানারের খোঁজ পাওয়া যায় উপজেলার গাজিরহাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পাশের বাজারে খোঁজ নিয়ে  কয়েকজন শিক্ষার্থীকেও পাওয়া যায় সেখানে।

 

 ওই কেন্দ্রের শিক্ষার্থী নূর ইসলাম সিটি নিউজ ঢাকাকে জানান,  তারা মাসখানেক আগে একদিন এসেছিলেন। এক দিনের জন্য বই হাতে ছবি তুলে আবার বইগুলো ফিরিয়ে নিয়ে যান। 
 

আরেক শিক্ষার্থী মোক্তার হোসেন বলেন, বুড়া বয়সে ভাবছিনো শিক্ষিত হমো এটে। তা কই পড়া লেখা? ছবি তুলিয়া একটা করে কেক খিলে চলি গেলো। আর ওমার দেখায় মিলিল না। 

 

শহীদবাগ ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের এক কেন্দ্রের দায়িত্ব প্রাপ্ত শিক্ষক হাফিজুর ইসলাম প্রজেক্টের আওতায় ঠিক মতো ক্লাস না নেওয়ার কথা  স্বীকার করে বলেন, এনজিও কতৃপক্ষ তো কোনো বেতনে দিত না তখন, তাহলে আমরা কি ভাবে গিয়ে ক্লাস নিব...! তবু যতটুকু সম্ভব হয়েছে আমার স্কুলে কিছু ক্লাস নিয়েছি।কিন্তু এখন ৬ মাস পর শুনতেছি বেতন থেকে নাকি এনজিও কতৃপক্ষ একটা এমাউন্ট কেটে নিয়ে তারপর দিবে।

 

বিষয়টি নিয়ে কথা হলে কাউনিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাহমিনা তারিন মুঠোফোনে  বলেন, কোন এনজিওর টাকা ইউএনওর অ্যাকাউন্টে গ্রহণের সুযোগ নেই। ওই চেক তিনি ছুঁয়েও দেখেননি বলে দাবি করেন। প্রকল্পটি ঠিকভাবে চলেনি শিকার করে তিনি বলেন, শুরুর পর সংশ্লিষ্টরা টাকা-পয়শা না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলো। 

 

এনজিও নগরের চিফ প্রজেক্ট ভিজিটর ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাহিত্য - সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক  মাহমুদুল হাসান পিন্টু বলেন, প্রকল্পটি কাগুজে ছিলো। পুরো সময় স্কুলগুলো না চললেও প্রকল্পের টাকা শেষ পর্যন্ত তোলা যাবে এমন আশা পাওয়ার পর তিনি দুয়েক দিনের মধ্যে কাগজপত্র তৈরী করে ঢাকায় গিয়ে ২০ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত টাকা উদ্ধার করতে পারার কৃতিত্ব দাবি করেন। 

 

ওই প্রজেক্টে এনজিওর দায়িত্বপ্রাপ্ত এই স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা মাহমুদুল হাসান পিন্টু বলেন, এ কাজে কয়েকজন সুপারভাইজারও তাঁর সঙ্গে ঢাকায় গিয়েছিলেন। চেক হাতে পাবার পর সেই চেকসহ সবাই মিলে সেলফি তুলে ফেসবুকেও দিয়েছেন।

 

নগর এনজিওর  কো-অর্ডিনেটর শাহেদুল হক রাজু স্বীকার করে বলেন, প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সেভাবে হয়নি। পিডি অফিসে ২০ লাখ টাকা ঘুষ দেয়া হয়েছে বলে জোড়ালোভাবেই দাবি করেন। আর সে কারণেই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।   

 

এদিকে প্রকল্প পরিচালক শামিমুল হক পাভেল ২০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের কথা অস্বীকার করে বলেন, ৯৪ লাখ টাকাই এনজিও নগরকে ইস্যু করা হয়েছে। তবে প্রকল্পটি অস্তিত্বহীন থাকার প্রসঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ৬ মাস ধরে চলা এই প্রকল্পের ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সংশ্লিষ্টরা কেন তার কাছে অভিযোগ করলেন না?

 

এইচএ 



 

দেশজুড়ে সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ