দেশজুড়ে ডেস্ক
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দৌলতদিয়া ঘাটে গাড়িজটের সুযোগ কাজে লাগিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ঘাট-সংশ্নিষ্ট প্রভাবশালী চক্র। ঘাটে যানবাহনের সারি বড় হতে থাকলে পাল্লা দিয়ে বাড়ে দালাল চক্রের চাঁদার অঙ্কও।
এ ছাড়া ফেরিতে আনলোড হওয়া প্রতিটি গাড়ি থেকে বিআইডব্লিউটিসির কর্মচারীরা প্রকাশ্যে চাঁদা আদায় করেন। সংশ্লিষ্টদের হিসাব মতে, এভাবে প্রতি মাসে আদায় করা হয় অন্তত ১০ লাখ টাকা।
ঘাট দিয়ে পারাপার হওয়া সব পণ্যবাহী ট্রাকের চালককে দালাল চক্রের সদস্যদের হাতে অতিরিক্ত টাকা গুঁজে দিয়ে ফেরির নাগাল পেতে হয়। অতিরিক্ত টাকা খরচ না করে ট্রাকচালকের দৌলতদিয়া ঘাট পাড়ি দেওয়া প্রায় অসম্ভব। অভিযোগ রয়েছে, এই টাকার ভাগ ওপর মহল পর্যন্ত যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নাব্য, ফেরি সংকটসহ নানা কারণে ধুঁকছে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথ। অব্যাহত যানজটে যাত্রী ও পরিবহন চালকরা দিনের পর দিন ভোগান্তিতে পড়ছেন। এ অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের ছায়ায় গড়ে ওঠা দালাল চক্র, ট্রাফিক পুলিশ, ফেরি বুকিং কাউন্টার কর্মীসহ সুযোগসন্ধানীরা।
দিন নেই, রাত নেই- ঘাটের এসব চক্র চাঁদা তুলতে বেপরোয়া থাকে সব সময়। এই অপতৎপরতা চালিয়ে নেওয়ার জন্য শতাধিক দাপুটে সদস্য ঘাটে সক্রিয় থাকে। ঈদ মৌসুমে স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট যানবাহন পারাপারে সচেষ্ট থাকলেও ঘাটের পয়েন্টে পয়েন্টে দেখা যায় চিহ্নিত দালালদের অপতৎপরতা।
ঘাট-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঈদের আগে যানবাহনের চাপ বাড়ায় স্থানীয় প্রভাবশালী দালালদের নড়াচড়া আরও বেড়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধির ইন্ধনে তাদের লোকজন আগেভাগে ফেরিতে ওঠার ব্যবস্থার কথা বলে পণ্যবাহী গাড়ি থেকে বাড়তি টাকা নেওয়ার অভিযোগ বহু পুরনো। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা তরমুজবাহী কাভার্ডভ্যান, ট্রাক, মাছের গাড়ি, অন্য ফলের গাড়ি থেকে নির্ধারিত টিকিটের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে।
ঘাট-সংশ্নিষ্ট এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যসহ সরকারদলীয় স্থানীয় কয়েকজন নেতা ফলের গাড়ি থেকে নিয়মিত টাকা তোলেন। প্রতিটি গাড়ি থেকে নির্ধারিত ভাড়ার সঙ্গে অতিরিক্ত ১৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। কখনও কখনও টাকার অঙ্ক আরও বাড়ে। এ ছাড়া মাছবাহী ট্রাক থেকে টাকা আদায় করেন স্থানীয় যুবলীগের এক নেতা।
বুধবার (২৭ এপ্রিল) দুপুর ২টার দিকে দৌলতদিয়া ৫ নম্বর ফেরিঘাট পন্টুনে কথা হয় বরগুনা থেকে তরমুজবোঝাই করে আসা ট্রাকচালক আবু জাহার সঙ্গে। তিনি জানান, এক হাজার ৬০ টাকা মূল্যের ফেরির টিকিট দালালদের মাধ্যমে দুই হাজার টাকায় পেয়েছি। আজ গাড়ির সিরিয়াল অন্যদিনের চেয়ে একটু কম, তাই কম টাকায় ফেরির টিকিট পেয়েছি। নিজেরা টিকিট সংগ্রহ করেন না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'নিজেরা টিকিট করে বিপদে পড়ব নাকি? দালালদের মাধ্যমে টিকিট না নিলে ঘাটে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়। তাই আমরা সব সময় দালালদের মাধ্যমে টিকিট নিয়ে থাকি।'
এর আগে মহাসড়কের দৌলতদিয়া মডেল হাইস্কুলের সামনে সিরিয়ালে আটকে থাকা ভোমরা স্থলবন্দর থেকে আসা বেদানাবোঝাই ট্রাকচালক রফিকুল ইসলাম জানান, শাহিন নামের এক ব্যক্তি তার ফেরির টিকিট সংগ্রহ করে দেন। বিনিময়ে গাড়ির সিরিয়াল অনুযায়ী টিকিট দরের চেয়ে ৫০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়।
সাতক্ষীরা থেকে ছেড়ে আসা ব্যাটারিবোঝাই কাভার্ডভ্যান চালক মো. রেজাউল জানান, শামীম নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি তার ফেরির টিকিট সংগ্রহ করে দেয়। এর বিনিময়ে তাকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়।
জানা যায়, দৌলতদিয়া ঘাটের অবৈধ আয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন দলের একাধিক গ্রুপ মারমুখী হয়ে ওঠে। এ নিয়ে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।
এদিকে ফেরি থেকে নামার সময় বিআইডব্লিউটিসির কর্মচারীরা প্রতিটি গাড়ি থেকে প্রকাশ্যে ১০ টাকা করে আদায় করেন। দীর্ঘদিন ধরে এই অনিয়ম চলে আসায় প্রতিটি যানবাহনের চালক বিনাবাক্যে ১০ টাকা দিয়ে থাকেন। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথ দিয়ে প্রতিদিন সাড়ে তিন থেকে চার হাজার গাড়ি পারাপার হয়।
এভাবে প্রতিটি যানবাহন থেকে ১০ টাকা করে নিলে প্রতিদিন আদায় হয় গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। সরেজমিনে বুধবার দৌলতদিয়া ঘাটের ৫ নম্বর পন্টুনে গিয়ে দেখা যায়, ফেরি থেকে নামার সময় প্রতিটি গাড়ির সামনে বিআইডব্লিউটিসির একজন কর্মচারী গিয়ে দাঁড়িয়ে চালকের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন। ওই কর্মচারীকে কীসের টাকা আদায় করছেন? জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, 'বকশিশ'। নাম জিজ্ঞেস করতেই তিনি রেগে বললেন, 'নাম দিয়ে কী করবেন, ছবি তুলবেন না।'
ঈদের পাঁচ দিন আগে এবং ঈদের পাঁচ দিন পর পর্যন্ত পণ্যবাহী গাড়ি বন্ধ থাকবে- কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্ত জানার পর বুধবার পণ্যবাহী গাড়ির বাড়তি চাপ কমতে শুরু করে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক প্রফুল্ল চৌহান বলেন, কে গাড়িচালক, কে হেলপার, আর কে দালাল, তা চিহ্নিত করা আমাদের জন্য কঠিন। আমার লোকজন থাকে চার দেয়ালের মধ্যে, বাইরের সব বিষয়ে তাদের খেয়াল করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব।
এ ব্যাপারে গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আজিজুল হক খান মামুন বলেন, ঘাট এলাকা দালালমুক্ত রাখতে স্থানীয় প্রশাসন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করা হয়। তিনি বলেন, ফেরির ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করা গেলে এ সংকট কেটে যাবে।
এফএ/এএল
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন