• ঢাকা মঙ্গলবার
    ০৮ এপ্রিল, ২০২৫, ২৫ চৈত্র ১৪৩১

ঝুঁকিপূর্ণ ক্বিন ব্রিজ: দায় নেই সংশ্লিষ্টদের

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২২, ০৭:৩৪ পিএম

ঝুঁকিপূর্ণ ক্বিন ব্রিজ: দায় নেই সংশ্লিষ্টদের

দেবব্রত রায় দিপন, সিলেট ব্যুরো

‘সহসা ফিরিয়ে চোখ দিয়ে দেখি দূর পুবাকাশে/তরুণ রক্তের মতো জাগে লাল সাহসী অরুণ/ পাখির কাকলি জাগে। ঝিরঝিরে শীতল বাতাসে/ দিনের যাত্রার শুরু। অন্তরালে রজনী করুণ!/ ধারালো বর্শার মতো স্বর্ণময় সূর্যরশ্মি ফলা/ ক্বিন-ব্রিজে আঘাত হানে। শুরু হয় জন তার চলা।’


বলছি সিলেটের ঐতিহাসিক ক্বিন ব্রিজের কথা। নিচে সুরমার স্বচ্ছ জল। নদীর দু’তীরে নাইতে নেমেছে কিশোরের দল। ঢেউয়ের তালে নৌকাগুলো ছুটছে এপার-ওপার। ব্রিজের ঠিক নিচে (উত্তরপাড়ে) রয়েছে ত্রিমুখী চত্বর। এখান থেকে পশ্চিম দিকে এই রাস্তা সিলেট কোতোয়ালি থানা হয়ে চলে গেছে কাজিরবাজারে। আর পূর্বদিকে সার্কিট হাউসের রাস্তা ঘেঁষে চলে গেছে কালিঘাট ও মহাজনপট্টিতে। আর উত্তর দিকের সোজা রাস্তাটি সুরমা মার্কেট হয়ে বন্দরবাজার।


ব্রিজটির ঠিক উত্তর-পূর্ব কোণে সিলেট সার্কিট হাউস, দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে ঐতিহাসিক আলী আমজদের ঘড়ি। ব্রিজের নিচে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ ‘রবীন্দ্র্র স্মৃতিস্তম্ভ’। ঠিক বিপরীত পাশে সিলেটের আরও এক ঐতিহ্যের স্বাক্ষর ‘সারদা স্মৃতি হল। আর এক কদম এগোলেই সিলেটের কিংবদন্তি প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পীর হবিব নামকরণে ‘পীর হবিব পাঠাগার’।

ক্বিন ব্রিজ ছাড়াও সিলেটে সুরমা নদীর ওপর ব্রিজ রয়েছে আরও দুটি। পাশাপাশি অবস্থিত আরও দুটি ব্রিজ যথাক্রমে শাহজালাল ব্রিজ এবং কাজিরবাজার ব্রিজ। কিন্তু সিলেটে কালের সাক্ষী এবং ঐতিহ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এই ক্বিন ব্রিজ। ক্বিন ব্রিজ সংলগ্ন এই স্থানে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনা রয়েছে।

দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীসহ সবাই আসতে হয় ক্বিন ব্রিজের লাগোয়া সার্কিট হাউসে। কিন্তু এর পরিবেশ অনেকটা ভয়াবহ। যন্ত্রদানব ড্রেজারের কবলে যৌবন হারিয়েছে নদী সুরমা। নদীর দু’তীর দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। ময়লা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে নদীর দু’তীরে। সার্কিট হাউসের সামনে ট্রাকের দীর্ঘ লাইন। নদীর উত্তর পাড়ের সৌন্দর্যবর্ধক রেলিংজুড়ে ভাসমান হকারদের রাজত্ব।

ক্রেতা-বিক্রেতাদের প্রতিদিনকার ময়লা যেখান থেকে যাচ্ছে নদীতীরে। নদীর সৌন্দর্য গিলে খাচ্ছে ময়লা-আবর্জনা থেকে নির্গত দুর্গন্ধ। আর ক্বিন ব্রিজের কথা বলাই বাহুল্য। ১৯৩৬ সাল থেকে চলছে যার পথচলা। বয়সে শতক পূরণ না হলেও ক্ষতচিহ্ন ফুটে উঠেছে ব্রিজটির বহু স্থানে। স্থানে স্থানে গর্তের পাশাপাশি ব্রিজের ব্যবহৃত বাতিগুলোও নিষ্ক্রিয়। এই সুযোগ রাতের বেলা কাজে লাগাচ্ছে ছিনতাইকারী চক্র।


ব্রিজের ওপর দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবুও প্রতিদিন চলাচল করছে ভারী যানবাহন। ব্রিজের অধিকাংশ জায়গা নিয়ে ব্যবসা করছেন ভাসমান হকার। সিসিকের দায়সারা তদারকিতে ক্ষুব্ধ সিলেটের মানুষ। তাদের দাবি- ক্বিন ব্রিজ সিলেটকে রেখেছে অনন্য উচ্চতায়। এই ব্রিজ পরিদর্শনে এসে মুগ্ধ হয়েছেন দেশি-বিদেশি পর্যটকরা। এই ব্রিজ দিয়ে জনতার পথচলা শুরু ১৯৩৬ সাল থেকে।

ব্রিজটি নিয়ে গণমানুষের কবি দিলওয়ার লিখেছেন বিখ্যাত কবিতা ‘ক্বিন ব্রিজে সূর্যোদয়’। কবি দিলওয়ার নেই। আছে সিলেটের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ঐতিহাসিক ক্বিন ব্রিজ। ৮৬ বছরের এই ব্রিজটির ওপর দিয়ে ধকল গেছে যৌবনে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হায়েনারা ডায়নামাইট দিয়ে ব্রিজটির উত্তরপাশের একাংশ উড়িয়ে দেয়।

পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের সহযোগিতায় ব্রিজের বিধ্বস্ত অংশটি কংক্রিট দিয়ে পুনর্নির্মাণ করা হয়। সংস্কারকৃত ব্রিজটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন নৌবাহিনীর প্রধান রিয়াল অ্যাডমিরাল এম এইচ খান। সুরমা নদীর ওপর লৌহনির্মিত সেতুটি সিলেটের অন্যতম একটি দর্শনীয় এবং ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে সবার কাছে পরিচিত।

এই ব্রিজটিকে সিলেট শহরের ‘প্রবেশদ্বার’ বলা হয়। শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ব্রিজটির একদিকে দক্ষিণ সুরমা, অন্যদিকে তালতলা। সিলেট রেলওয়ে স্টেশন থেকে এই ব্রিজটি মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ব্রিজটির নামকরণ করা হয় আসামের তৎকালীন গভর্নর মাইকেল ক্বিনের নামানুসারে। গভর্নর থাকাকালীন (১৯৩২-১৯৩৭) তিনি সিলেট সফরে আসেন। তার স্মৃতিকে অম্লান এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার তাগিদ থেকেই সুরমা নদীর ওপর এ ব্রিজটি নির্মাণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

এরই অংশ হিসেবে রেলওয়ে বিভাগ ১৯৩৩ সালে সুরমা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং নির্মাণ শেষে ১৯৩৬ সালে ব্রিজটি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া হয়। ১১৫০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৮ ফুট প্রস্থের ব্রিজটি নির্মাণে তৎকালীন ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৫৬ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর সংস্কারের জন্য ক্বিন ব্রিজ দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)।

এর আগে প্রবেশমুখে লাগানো হয় সাইনবোর্ড। সেখানে উল্লেখ করা হয় রিকশা, ভ্যান ও মোটরসাইকেল ছাড়া অন্য সব ধরনের যানবাহন এ সেতু দিয়ে চলাচল করতে পারবে না। কিন্তু এসবে পাত্তাই দেয়নি গাড়িচালকরা। কর্তৃপক্ষও নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে নেয়নি কোনো উদ্যোগ। নিষেধাজ্ঞা প্রদান ও ভঙ্গেও এক আজব খেলা চলছিল ক্বিন ব্রিজ ঘিরে।

ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজটিতে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার সংস্কারকাজ করা হয়েছে। ফলে ওই সময় বন্ধ করে দেওয়া হয় রিকশা চলাচলও। তবে দক্ষিণ সুরমার মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে কিছুদিন পর রিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেল চলাচলের সুযোগ করে দেওয়া হয়। কিন্তু পরে কে বা কারা লোহার ব্যারিকেড তুলে ফেলে। শুরু হয় অটোরিকশা, প্রাইভেটকার, লাইটেসসহ সব ধরনের যান চলাচল।

এদিকে, সিলেটের অধিকাংশ মানুষের দাবি, ব্রিজটি যান চলাচলমুক্ত রাখা হোক এবং সেটি হলে সিলেটের ক্বিন ব্রিজ হবে বিশ্বের একমাত্র হাঁটার ব্রিজ। সিলেট সিটি করপোরেশন একবার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও দক্ষিণ সুরমার অধিকাংশ মানুষ সেটির বিরোধিতা করে সিসিকের বিরুদ্ধে আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠে। ব্রিজের ওপর দিয়ে দক্ষিণ সুরমায় যাচ্ছিলেন গীতিকার ও সিলেট বেতারের শিল্পী সিরাজ আনোয়ার।

তিনি বলেন, ‘ইতিহাসের অংশ এই সিলেট ক্বিন ব্রিজ। ব্রিজের বিভিন্ন স্থানে এখন গর্ত। সোডিয়াম বাতিগুলো অকার্যকর।’ তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে আশু হস্তক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান।

ক্বিন ব্রিজ সংস্কারের বিষয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম হাওলাদার বলেন, ‘ব্রিজটি সংস্কার কার্যক্রমের জন্য গত অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে রেল বিভাগকে। শর্ত অনুযায়ী চলতি অর্থবছর সংস্কার কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা। কেন যে এখনও কাজ শুরু হয়নি, সে বিষয়টি তারাই ভালো বলতে পারবেন।’


বরাদ্দকৃত টাকা কত ছিল- এ বিষয়ে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে ঠিক অঙ্কটা মনে নেই। কাজ শুরুর বিষয়ে রেলের সিলেট বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘যেহেতু মেয়াদ এখনও রয়েছে, সেক্ষেত্রে হতাশ হওয়ার কিছু নেই।’

সেতু প্রকৌশলী (রেল বিভাগ, পূর্ব) আবরার হোসেন বলেন, সংস্কারকাজের জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এখন দরপত্র মূল্যায়নের অপেক্ষায়। দরপত্র মূল্যায়ন চূড়ান্ত হলেই কাজ শুরু করা যাবে। সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যে কী আছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ফোনে তো ভাই এত কিছু বলা যাবে না।’

সিসিকের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী সিসিক বিগত দিনেও ব্রিজটির সংস্কারে গুরুত্ব আরোপ করেছিল। পরে কিছুসংখ্যক মানুষের আন্দোলন ও প্রতিবাদের মুখে পিছু হটতে হয়েছে।

কেজেড/এফএ

আর্কাইভ