• ঢাকা রবিবার
    ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১

বোরো চাষে লাগামছাড়া ব্যয়ে ভরসা জিকে প্রকল্প

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২, ১০:০৬ পিএম

বোরো চাষে লাগামছাড়া ব্যয়ে ভরসা জিকে প্রকল্প

শৈবাল আদিত্য


ডিজেল, সার, বীজ, কীটনাশকসহ শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় এবার কুষ্টিয়ায় বোরো আবাদে কৃষকদের ব্যয় আগের তুলনায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। বেড়েছে সেচ খরচও। ব্যয় বাড়ায় সামনে ধানের বাজার আরও বাড়বে বলে মনে করছেন কৃষকরা। তাই তারা জিকের পানির ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছেন। 

 

কৃষি অফিসের তথ্যমতে, কুষ্টিয়া জেলায় এবার বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার হেক্টর। ইতিমধ্যে কৃষকরা মাঠ প্রস্তুত করে বোরো চারা রোপণ শুরু করেছেন। অনেক কৃষক পরিচর্যা করছেন। বাকিরা বীজতলা থেকে চারা তুলে জমিতে রোপণ করছেন। তবে বোরো আবাদের শুরুতেই এবার কৃষকদের গাঁট থেকে বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে। বিশেষ করে ডিজেলের দাম বাড়ায় পানির খরচ বেড়েছে। পাশাপাশি বীজ, সার ও শ্রমিকের পেছনে বাড়তি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে তাদের। গত বছরের তুলনায় এবার প্রতি বিঘায় একজন কৃষকের বাড়তি খরচ হবে কয়েক হাজার টাকা। সবমিলিয়ে ব্যয় বেড়ে যাবে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ।

 

সদর উপজেলার পাটিকাবাড়ি ইউনিয়নের পাটিকাবাড়ি গ্রামের কৃষক ইব্রাহীম হোসেন। তিনি এ বছর বোরো আবাদ করছেন ২৬ কাঠা। এরই মধ্যে চারা রোপণ শেষ করে পরিচর্যা শুরু করেছেন।

 

কৃষক ইব্রাহীম হোসেন বলেন, ‘এবার বোরো চারা কেনা থেকে শুরু করে জমি প্রস্তুত, রোপণ সবখানেই গত বছরের তুলনায় বেশি ব্যয় হয়েছে। গত বছর এক নল চারা কিনেছিলাম মাত্র ৫০ টাকা দিয়ে। এবার সেই এক নল চারা কিনেছি ২০০ টাকা দিয়ে। ২ হাজার টাকার চারা কিনতে হয়। শুধু চারা কিনতে বাড়তি খরচ হয়েছে প্রায় এক হাজার ৫০০ টাকা। এরপর একবার চাষ দিতে ৩০০ টাকা দিতে হয়েছে। ট্রাক্টর দিয়ে ৪ বার জমি চাষ দিতে গুনতে হয়েছে এক হাজার ২০০ টাকা।'

 

গত বছর তেলের লিটার ছিল ৬৫ টাকা, এবার তা ৮০ টাকা। ২৬ কাঠায় জমি প্রস্তুত ১০ লিটার তেল খরচ হয়েছে। গ্রামের খুচরা দোকানে ৮০ টাকার তেল বিক্রি হচ্ছে ৮৪ থেকে ৮৫ টাকা লিটার। ৮৮৪ টাকার তেল কিনতে হয়েছে। তেলে প্রায় ২০০ টাকা বেশি লেগেছে। এরপর জমিতে মই দিতে ৩০০ টাকা। এক বিঘা জমিতে ধান লাগাতে দিন হাজিরার লেবাররা নিয়েছেন এক হাজার ৫০০ টাকা। সবমিলিয়ে চারা রোপণ করতে খরচ হয়েছে প্রায় ২ হাজার টাকা। গতবার এ খরচ ছিল এক হাজার ২০০ টাকার মতো। এর পাশাপাশি তিনি সার কিনেছেন এক হাজার ২০০ টাকার। সব মিলিয়ে খরচ পড়েছে ৭ হাজার ৫৮৪ টাকা। সামনে দুই দফার সার, পোকা মারার জন্য কীটনাশক প্রয়োগ, কাটা ও ঝাড়ার খরচ তো পড়েই আছে।

 

ইব্রাহীম বলেন, ‘খরচ সব মিলিয়ে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ বেড়েছে। এতে বোরো আবাদ অনেক চাষি করেনি। আবার আবাদ গতবারের তুলনায় অনেকে কম করেছেন শুধু খরচ বাড়ার কারণে। এসব জমিতে ভুট্টা আবাদ করছেন অনেকে। পরে বৃষ্টির মৌসুমে আউশ ধান আবাদ হবে ওইসব জমিতে।’

 

একই গ্রামের কৃষক চাঁদু মণ্ডল বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত দামে তেল, সার ও বীজ পাওয়া যায় না। গ্রামের কৃষকদের বাজার তুলনায় বেশি দামে কিনতে হয়। এতে উৎপাদন খরচ বেশি হয়। ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া কোনো সারই গ্রামের বাজারে নির্ধারিত দরে বিক্রি হয় না। ২ থেকে ৩ টাকা বেশি এমনকি ধানের মৌসুমে ৮০০ টাকার এক বস্তা ইউরিয়া এক হাজার ২০০ টাকা দিয়েও কিনতে হয়। এ ছাড়া সরকার প্রতি লিটার তেলের দাম বাড়িয়েছে ১৫ টাকা, সেই তেল খুচরা পর্যায়ে এসে আরও ৩ থেকে ৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।’

 

 দুর্গাপুর ইউনিয়নের নরহরদিয়া গ্রামের কৃষক গনি মালিথা বলেন, ‘বোরো চাষে এবার খরচ বেশি হচ্ছে। বিশেষ করে ধান লাগাতে ৩০০ টাকায় লেবার পাওয়া গেলেও এবার সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার বেশি লাগছে। আবার লেবাররা ছোট ছোট দল করে  প্রতি বিঘার জন্য এক হাজার ৫০০ টাকা দর নির্ধারণ করেছেন। এতে তাদের আরও বেশি ব্যয় হচ্ছে। গতবার এক বিঘায় খরচ চারা রোপণ পর্যন্ত ৫ হাজার টাকায় সারা গেলেও এবার ৬ হাজার টাকার বেশিই লাগছে।’

 

ইউনিয়ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করা কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতবারের তুলনায় এবার বোরো উৎপাদন কিছুটা হলেও কমেছে। ধানের বাজার বেশি পেলেও উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে সেই লাভ আর কৃষকের থাকবে না। সে হিসাব করে অনেকে আবাদ কম করছেন।

 

কৃষকরা জানান, এক বিঘায় বোরো আবাদ করে ফলন পাওয়া যায় গড়ে ২০ মণ। বাজার ভালো থাকলে ২০ হাজার টাকা ধান বিক্রি করে পাওয়া যায়। আর বিছালি বিক্রি করে পাওয়া যায় ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে আয় ২৫ হাজার টাকার মতো। তবে খরচ বেড়ে গেলে লাভের পরিমাণ কমে যাবে বলে আশঙ্কা তাদের। সেখানে অন্য ফসল আবাদ করে কৃষক দ্বিগুণ লাভ পাচ্ছেন।

 

এ অবস্থায় সেচ খরচ বাঁচাতে জেলার তিন উপজেলার কৃষকরা জিকের পানির ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছেন। বিশেষ করে পুরো মৌসুমে জিকের পানি পেলে তাদের সেচ খরচ সাশ্রয় হবে। জিকের পানি দিয়ে এক বিঘা জমি আবাদ করতে কৃষকদের ব্যয় হয় মাত্র ২০০ টাকা। এবার তেলের বাড়তি দামের কারণে অনেক কৃষক জিকের পানির দিয়ে আবাদ করছেন।

 

সদর উপজেলার বটতৈল এলাকার কৃষক জাভেদ মিয়া বলেন, ‘জিকের পানিতে আবাদ করে অনেক লাভ হয়। এক বিঘায় খরচ মাত্র ২০০ টাকা। তবে শুষ্ক মৌসুমে অনেক সময় পদ্মায় পানি কমে গেলে ক্যানালে পানি থাকে না। তখন আবার স্যালোর পানির প্রয়োজন হয়। তবে আবাদের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত জিকের পানি পেতে সমস্যা হয় না।’

 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আফছার উদ্দিন জানান, গত বছর একটি পাম্প অচল ছিল। এবার সেই পাম্পটি সচল করা হয়েছে। দুটি পাম্প সচল রয়েছে। পানির কোনো সমস্যা হবে না। কুষ্টিয়াসহ তিন জেলার কৃষকরা জিকের পর্যাপ্ত পানি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রতিটি ক্যানেলেই এখন পানি রয়েছে। কৃষকরা সেই পানি দিয়ে আবাদ করছে।

 

কুষ্টিয়া খামার বাড়ির অতিরিক্ত উপ-পরিচালক বিষ্ণু পদ সাহা জানান, এবার বোরো রোপনের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার হেক্টরের সামান্য বেশি। ৮০ ভাগ অর্জিত হয়েছে। বাকিটাও অর্জিত হবে বলে মনে করেন তিনি। তবে গত বারের তুলনায় এবার উৎপাদন খরচ কিছুটা বেড়েছে, তারপরও ধান আবাদে কৃষকরা লাভবান হবে বলে জানান তিনি।


জেডখান/ফিরোজ

দেশজুড়ে সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ