
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২২, ২০২২, ১০:২২ পিএম
মো. তারেক রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
মাটির
নিচ থেকে যান্ত্রিক উপায়ে অপরিকল্পিত পানি উত্তোলনের কারণে ধীরে ধীরে নিম্নমুখী
হচ্ছে পানির স্তর। মাটির গভীরে থাকা পাথরের স্তর, বালুসহ প্রাকৃতিক বহু ধরনের
মাটি কেটেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের উঁচু এলাকাগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে না সুপেয়-স্বচ্ছ খাবার পানির
পাশাপাশি সেচকাজে ব্যবহারযোগ্য পানিও। আর এ কারণেই বরেন্দ্র এলাকা খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ
সদরসহ জেলার উঁচু ভূমি নাচোল, গোমস্তাপুর, ভোলাহাট এবং শিবগঞ্জ উপজেলার আংশিক এলাকায়
শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য মানুষের হাহাকার যেন নিত্যসঙ্গী।
স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের ভাষ্য মতে, অপরিকল্পিত উপায়ে অগভীর নলকূপ স্থাপন করে লাগামহীনভাবে পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। মাটির নিচে ভারী মেশিন বসিয়ে দেড়, তিন, চার বা ছয় ইঞ্চি পাইপ স্থাপনকালে ৫৬ থেকে ৭৮ ফুট নিচে পাথরের স্থর পাওয়া যাচ্ছে। অত্যাধুনিক মেশিনে সেই পাথর কেটে মাটির আরও গভীরে গিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না ব্যবহারযোগ্য পানি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর এবং স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্যানুয়ায়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে সরেজমিন গিয়ে এবং মাটি, পানি, পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে কাজ করে এমন দফতরে কথা বলে হতাশাজনক তথ্য পাওয়া যায়। দফতরগুলোর দেয়া তথ্যানুয়ায়ী, মাটির গভীর ভেদ করে এমন অপরিকল্পিত পানি উত্তোলন রোধ না করা গেলে অদূর ভবিষ্যতে মরুকরণ প্রক্রিয়ায় পড়বে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অধিকাংশ এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী জেলা রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর এবং নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর ও সাপাহার এলাকা।
বর্ষা-বন্যা
মৌসুমে কানায়-কানায় পানিতে ভরা; যৌবন পরিপূর্ণ থাকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের
ভোলাহাট উপজেলার বিলভাতিয়া বিলের। ভারত সীমান্ত লাগোয়া ১৯ হাজার বিঘা পরিধির এলাকায়
এই বিল ভাতিয়া। জলজ-উদ্ভিদ, দেশি মাছ, জলজ প্রাণীসহ বৈচিত্র্যময় এই বিলকে ঘিরে রয়েছে
নানা ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
আবহাওয়ার
বৈশ্বিক পরিবর্তন ও আমাদের অবিবেচনাপ্রসূত, লাগামহীন ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে
এই বিশ্ব যেমন উষ্ণ ও অবাসযোগ্য হচ্ছে। তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এবং পৃথিবীর জলজ ও
স্থলজ নানা প্রজাতিকে মারাত্মক হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়া হচ্ছে। ফলে প্রত্যেক দিন হারিয়ে
যাচ্ছে অসংখ্য জীববৈচিত্র্য। এই বিলে জন্মায় প্রচুর প্রাকৃতিক দল ঘাস। জমির উর্বরতা বৃদ্ধির
জন্য ভোদ ও ভেদর, পদ্ম, শাপলা, শালুক, চাকা, মাখনা সিংগারা, ভ্যাট ইত্যাদি। দলবেঁধে
আসে নানা বর্ণের দেশি-বিদেশি অতিথি পাখি। মানুষ আর পশু-পাখির কলকাকলীতে ভরে থাকে এই
ভাতিয়ার বিল। হারিয়ে গেছে সেই সৌন্দর্য। হারিয়ে গেছে পানি।
বিলভাতিয়া
এখন নামে মাত্র পড়ে আছে। যৌবন-জৌলুশ কিছুই নেই। চেনার উপায় নেই বিলভাতিয়াকে। যেখানে থইথই পানি, ফুটে থাকত পদ্ম। হাজারও মানুষ সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসতেন, সে জায়গাতে
আজ একচিলতে পানিও নেই। পদ্মফুল, লতাগাছের মরদেহ শুকিয়ে পড়ে আছে। প্রচণ্ড দাবদাহে
মাটি ফেটে বিলের চারদিক হাহাকার করছে। শুকনা বিলের কোথাও ঘাস নেই।
গোখাদ্য হিসেবে পরিচিত ঘাসের সন্ধানে গরু নিয়ে ছুটে চলা ৩৫ বছরের কৃষক রবিউল ইসলাম রবু। তাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে বিলভাতিয়ার কথা জানতে চাইলে, তিনি হতাশকণ্ঠে স্থানীয় ভাষায় বলেন- ‘যেখানে খাড়িয়া আছি, ওখ্যানে পদ্মফুল ফুটে থাকত। আর এখন! দশ বছরের মধ্যেও দেখা যায়নি জি। হারা ছোট থাকতে গরু চরাতে আইসা পদ্মচাকা, ভ্যাটফুল তুলে লিয়্যা গেছি বাড়ি। বাহির থেকে প্যান্ট-শাার্ট পরা মানুষ আইসা নৌকায় চড়ে পদ্মচাকা তুলত, ছবি তুলত। অনেকেই পিকনিক বা বাড়িতে খানা দিলে পদ্মপাতা তুলে নিয়ে যেত। আজ এ জায়গাটা শুকিয়ে খাঁ খাঁ। পদ্মচাকার গাছ গালা মরে গেছে। চিনায় যায় না এখানে পদ্মচাকার গাছ ছিল।’
বিলভাতিয়া
মাঠে আসা কৃষক সহিমুদ্দিন বলেন, ‘ভাইত্যাতে পানি ন্যাই। প্রচণ্ড তাপে শুকিয়া সব জায়গাতে
ফাটল ধরেছে। যার কারণে পদ্মচাক্কা, শাপলা, শালুক, চাকা, মাখনা সিংগারা, ভ্যাটসহ নানা
প্রকার জলজ উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।’ তিনি জানান, বিল ভাতিয়ায় এখন পানি নেই,
জমি চাষাবাদ করতে হলে, যন্ত্রচালিত শ্যালো মেশিন আট-দশ হাত মাটি খনন করে নিচে বসানোর
পর পানি পাওয়া যায়।
এ
বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ভোলাহাট উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ওয়ালিউর রহমান জানান,
দিনের পর দিন মানুষ মাটি কেটে বিল ভরাট করে; আবাদি জমি তৈরি করা এবং স্লুইসগেট শিবগঞ্জ
উপজেলার মানুষের নিয়ন্ত্রণে। তারা তাদের ইচ্ছামতো পানি বের করার কারণে বিলভাতিয়া পানিশূন্য হয়ে যায়। তিনি জানান, সরকার প্রকল্প গ্রহণ করে যদি দিঘি তৈরি করে তবে পানি সংরক্ষিত
হয়ে কৃষি, জলজ উদ্ভিদ ও দেশি মাছ পাওয়া যাবে।
ভোলাহাট
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান খান জানান, জলজ উদ্ভিদ ফিরে পেতে হলে দেশের দ্বিতীয়
বৃহত্তম বিল-বিলভাতিয়ার ওপর সরকারকে ব্যাপক প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। খনন করে পানি ধরে
রাখলে জলজ উদ্ভিদ বাঁচানো যাবে। সেই সঙ্গে কৃষি ফসল উৎপাদনে কৃষকের পানির সমস্যা
হবে না। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, ভারসাম্য আসবে স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশে।
এমন
অবস্থা শুধু ভোলাহাটের বিলভাতিয়া বিলেই নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে
বয়ে যাওয়া পদ্মার শাখা নদী পাগলারও একই অবস্থা। বর্ষা-বন্যা মৌসুমে উত্তাল থাকে পাগলা
নদী, শুকনো মৌসুমে সরু নালা যেন।
স্থানীয়
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান জানালেন, চৈত্র-বৈশাখে পদ্মা নদীর
শুষ্কতায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পাগলা নদী। বিপর্যস্ত প্রকৃতির বৈরিতায় পাগলা এখন মরা
নদী, সরু নালা। দূর-দূরান্তের কৃষিজীবীরা ভারী মেশিনের সাহায্যে আট ও বারো ইঞ্চি পাইপের
সাহায্যে পাগলা নদী থেকে পানি নিয়ে যান আবাদী জমিতে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই কর্মকর্তার
দাবি, এর বিরূপ প্রভাব পড়ে প্রকৃতির ওপর। রুক্ষতা বাড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে।
সরেজমিন দেখা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের বিলভাতিয়ায় ৯ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন আব্দুর রহিম। নিজস্ব শ্যালো মেশিনে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে গত বছর থেকে বোরো ধানের চাষ করছেন তিনি। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনক নিচে নেমে যাওয়ায় সেচ দিতে না পারায় ফাটল ধরেছে জমিতে। অবশেষে তার শ্যালো মেশিনটি গর্ত করে ১০-১২ ফুট নিচে নামিয়ে পানি উঠানোর চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। হতাশ হয়ে আব্দুর রহিম ও তার ছেলেকে ফাটল ধরা জমির চারপাশ ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে।
আব্দুর রহিমের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘গত বছর ৯ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলাম। সে বছরও পানির সমস্যা হয়েছিল। বৃষ্টির পানিতে ধান বাঁচাতে পেরেছিলাম। এ বছর এখন পর্যন্ত বৃষ্টির পানি নেই। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গত বছরের চেয়ে নিচে নেমেছে। এতে শ্যালো মেশিনে সমতল থেকে ১০-১২ ফুট মাটির নিচ দিয়েও পানি উঠছে না।’ শেষ পর্যন্ত আমগাছে বিষ স্প্রে মেশিনের সাহায্যে ড্রামে পানি নিয়ে এসে ধানে স্প্রে করছেন তিনি।
তিনি
বলেন, ‘পাশের বিশু নামের এক কৃষকের শ্যালো মেশিনে পানি ওঠা বন্ধ হওয়ায় জমি ছেড়ে চলে
গেছে।’ তিনি দাবি করেন, এসব এলাকায় শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে যেসব বোরো ধান চাষ হয়েছে
সেসব জমির ধান সেচ সংকটে মরে গেছে। তিনি বলেন, ‘প্রায় আড়াই থেকে ৩ হাজার বিঘা জমির
ধান নষ্ট হয়ে গেছে।’
বোরো
চাষি তৈয়নুর রহমান বলেন, ‘পানি নিচে নেমে যাওয়ায় শ্যালো মেশিনে পাতাল থেকে পানি ওঠে
না। যার কারণে হাজার-হাজার বিঘা জমির ধান মরে গেছে। মাঠের সব শ্যালো মেশিন বন্ধ হয়ে
গেছে। মানুষ মরা ধান কেটে কেটে গরু-মহিষকে খাওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি
জানান, শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি উঠছে না। যার কারণে ধান মরে গেছে। স্কিমে ৩০ বিঘা জমিতে
বোরো ধান চাষ করেছিলাম। পানি না ওঠায় সব ধান মরে গেছে। এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে
শ্রমিক, সার-বিষ, হালচাষসহ খরচ হয়েছে ৮ হাজার টাকা। প্রায় আড়াই হাজার বিঘা জমিতে বিঘাপ্রতি ৮ হাজার টাকা খরচ হলে ২ কোটি টাকার ওপরে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে তিনি
জানান।
মইনুর
আরও বলেন, ‘শ্যালো মেশিনে ভূগর্ভস্থ পানির সমস্যা হলেও বৈদ্যুতিক সংযোগের মাধ্যমে সেমিডিপ
স্থাপন করলে এসব জমিতে পানি সংকট থাকবে না। ওই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি
কর্মকর্তা সেলিম রেজা জানান, শ্যালো মেশিনের পরিবর্তে বিদ্যুৎচালিত অগভীর নলকূপ বসালে
ধানের সমস্যা হবে না।’
খ্যাদ্যে
উদ্বৃত্ত এলাকা নামে পরিচিত উঁচু ভূমির বরেন্দ্র অঞ্চল নাচোল। শুষ্ক মৌসুমে প্রাকৃতিক
বিপর্যয়ের আতঙ্কে থাকেন সেখানকার কৃষক। ১৪ হাজার ৬২৬ হেক্টর জমিতে ধান আবাদ করা হয়।
শীষ ফোটা অধিকাংশ জমি থাকে পানিশূন্য-সেচ সংকটে। এখানে মাটির স্তর নিম্নমুখী, দুই-আড়াই শ’ ফুট মাটি খনন করেও সেচের পানি পাওয়া যায় না। স্থানীয় বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ)
সহকারী প্রকৌশলী বুলবুল আহম্মেদ জানান, তীব্র সেচ সংকটে অনাবাদী রাখতে হয় ফসলি জমি।
আর যে কৃষকেরা চাষাবাদ করেন, তাদের চেয়ে থাকতে হয় আকাশের বৃষ্টির দিকে, প্রকৃতির ওপর।
ওই
কৃষি কর্মকর্তা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে, উঁচু ভূমির বরেন্দ্র এলাকায়,
চৈত্র-বৈশাখে প্রচণ্ড তাপদাহে মাটি ফেটে চৌচির, প্রাণ ওষ্ঠাগত। জমির ধানক্ষেতে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত
হন কৃষক।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত কুমার সাহা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনে প্রকৃতি
রুদ্র। অপরিকল্পিত পানি উত্তলনই মূলত এ অবস্থার জন্য দায়ী।
বরেন্দ্র
উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, বরেন্দ্রের বিধান
ও কাঠামো অনুযায়ী গভীর নলকূপ স্থাপন না করে স্বেচ্ছাচার অনুয়ায়ী অতীতে স্বজনপ্রীতি
করা হয়। বসানো হয় গভীর নলকূপ। এর কারণে দুর্গতিতে পড়েছে সেচ নিয়ে কৃষক-জোতদার মানুষ।
যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে প্রকৃতিতে। এর পাশাপাশি অনেকাংশে দায়ী পরিবেশ বিপর্যয়ে যত্রতত্র
বৃক্ষ নিধন করা।
এএমকে/এম. জামান