
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২, ২০২২, ০২:১৮ এএম
রফিকুল ইসলাম, মাদারীপুর প্রতিনিধি
৩ মে ২০২১। সোমবার।
রোজার মাস। সেহরি খেয়ে নামাজ পড়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা। ভোর তখন সাড়ে ৬টা।
মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। ওপার থেকে ছোট ভাই হায়দারের কণ্ঠে ‘ভাই ঘাটে স্পিডবোট
দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ মরছে। দ্রুত আহেন। আমি এই হানে আছি। ঠিক পাচ্ছি না ও কি বলে।’ ঘুম থেকে ওঠে বেসিনে গিয়ে কুলি করতে করতে আবার ফোন- ‘আপনি রওনা হইছেন, লাশ
পাওয়া গেছে ৭টা।’ বাসায় থেকে উঠে মোটরসাইকেল টান দিয়ে ১৭ কিমি পথ চলে গেলাম ২০ মিনিটে।
সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে পদ্মার বাতাস স্বজনহারানো হাহাকারে ভারী হয়ে ওঠে। ২০২১ সালের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকে পদ্মা নদী। স্বজন হারিয়ে দিশেহারা পরিবারের আর্তনাদে থমকে থাকে চারপাশ। ততক্ষণে ২৬টি লাশ নদী থেকে তুলে ওঠানো হলো তীরে। সকাল ৯টার মধ্য মরদেগুলো নেয়া হলো শিবচর উপজেলা কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের দোতারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম আশ্রয়ণ সেন্টারে। বেলা যতই যাচ্ছে স্বজনদেরও আর্তনাদ বেড়েই চলছে। চলছে স্বজনদের লাশ শনাক্তের কাজ।
দিনটি ছিল সোমবার ভোর সোয়া ছয়টা। মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া থেকে ৩১ যাত্রী নিয়ে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে আসে একটি স্পিডবোট। দ্রুতগতির স্পিডবোটটি কাঁঠালবাড়ী ঘাটের কাছে এসে নদীর পাড়ে নোঙর করে রাখা একটি বাল্কহেডের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই ২৬ যাত্রীর মৃত্যু হয়। ভোর সোয়া ছয়টার দিকে এই দুর্ঘটনা ঘটলে সকাল ৮টার মধ্যেই যাত্রীদের মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়। মাথায় আঘাতের ফলেই যাত্রীর মৃত্যু হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
এ দুর্ঘটনায় আরও মারা যান মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বন্দরখোলা ইউনিয়নের মৌলভীকান্দি এলাকার আজিত মোল্লার ছেলে আলম মোল্লা (৩৮), শিবচর উপজেলার নিয়ামতকান্দী এলাকার আদম আলী মোল্লার ছেলে শাহাদাত হোসেন (২৯), রাজৈর শঙ্কারদি এলাকার তারা মিয়া মীরের ছেলে তাহের মীর (৩০), সদর উপজেলার শ্রীনদী এলাকার আবদুল মান্নান মোল্লার ছেলে আবদুল আহাদ (৩০), ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার মাইগ্রো এলাকার মৃত পান্নু সরদারের ছেলে আরজু সরদার (৪০) এবং আরজুর দেড় বছর বয়সী ছেলে ইয়ামিন, বরিশালের বন্দর থানার তেদুরিয়া এলাকার মো. আলী আহমেদের ছেলে আনোয়ার চৌকিদার (৫০), বানারীপাড়া উপজেলার হাশেম ব্যাপারীর ছেলে আলাউদ্দিন ব্যাপারী (৪৫), চাঁদপুরের মতলব উত্তর থানার মোহনপুর এলাকার মৃত আলী হোসেন ব্যাপারীর ছেলে মো. দেলোয়ার হোসেন (৪৫), নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার রাজাপুর এলাকার হাফিজুর রহমানের ছেলে জোবায়ের মোল্লা (৩০), কুমিল্লার তিতাস উপজেলার ইউসুফপুর এলাকার মৃত আবদুল মান্নানের ছেলে জিয়াউর রহমান (৩৮), দাউদকান্দি উপজেলার মাইখারকান্দি এলাকার মৃত আবদুল হাশেমের ছেলে মো. কাওসার আহমেদ (৪০), একই এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে মো. রুহুল আমিন (৩৬), মুন্সিগঞ্জের সাতপাড় এলাকার চান মিয়া শেখের ছেলে সাগর শেখ (৪১), বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার আশা এলাকার রত্তু হোসেনের ছেলে সাইদুল হোসেন (২৭), একই উপজেলার পূর্বষট্টি এলাকার সাদেক ব্যাপারীর ছেলে রিয়াজ হোসেন (৩৩) ও সাইফুল ইসলাম (৩৫), একই উপজেলার মনির হোসেন (৩৫), ঢাকার পীরেরবাগ এলাকার নুরে আলমের ছেলে খোরশেদ আলম (৪৫), ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার রাজাবাড়িয়া এলাকার মৃত আবদুল কুদ্দুস শিকদারের ছেলে নাসিরউদ্দিন (৪৫), পিরোজপুর জেলার সদর উপজেলার চরখানা এলাকার মো. ওহিদুরের ছেলে বাপ্পী (২৮) এবং পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার পসারিয়াবুনিয়া এলাকার রঞ্জন অধিকারীর ছেলে জনি অধিকারী (২৬)।
এই দুর্ঘটনার পর স্পিডবোট চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রশাসন। ১৫৬ দিন বন্ধ থাকার পর চালকদের প্রশিক্ষণ, ডোপটেস্ট, স্পিডবোটের নিবন্ধন, নির্দিষ্ট পরিমাণ যাত্রী ওঠানো ও নির্দিষ্ট ভাড়ার নিয়ম করে গত ৭ অক্টোবর থেকে বাংলাবাজার- শিমুলিয়া নৌরুটে পুনরায় স্পিডবোট চালু হয়।
সময়ের আবর্তনের সঙ্গে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে সবকিছু। সাধারণ মানুষ ভুলে যেতে থাকে ঘটনাগুলো। তবে সচেতনতাবোধ ভুলে আবার নৌরুটে নিয়মভাঙা বাড়তে থাকে। তবে ক্ষত থেকে যায় স্বজন হারানোদের বুকে। পদ্মার ঢেউয়ে ফিরে ফিরে আসে আপনজন হারানো ভয়াল স্মৃতি!
এই দুর্ঘটনায় খুলনার তেরখাদা উপজেলার পারুফল এলাকার মৃত আলম মিয়ার ছেলে এবং বেঁচে যাওয়া ছোট্ট মীমের বাবা মনির মিয়া (৩৮), মনির মিয়ার স্ত্রী হীনা বেগম (৩৬), তাদের মেয়ে রুমি আক্তার (৩) ও সুমি আক্তার (৫) মারা যান। দাদার মৃত্যুর খবর পেয়ে বাড়ি ফিরছিল মীমের পরিবার!
মা-বাবা আর ছোট্ট দুইবোন হারানো ৮ বছর বয়সী ছোট্ট মীম তখন নিজেদের ব্যাগ ধরে পদ্মার পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছিল। খুব ভোরে ঘুমঘুম চোখে কি ঘটেছিল তা আঁচ করার আগেই নিজেকে পানিতে ভাসতে দেখে বিস্ময়ের ঘোর তার কাটছিল না যেন। স্থানীয়রা যখন তাকে পানি থেকে উদ্ধার করছিল তখনও বুঝে উঠতে পারেনি কিছু। নদীর পাড়ে তোলার পর জ্ঞান হারায় সে। দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে নেয়া হয়। ততক্ষণে পদ্মার তীরে তার মা-বাবা আর ছোট্ট দুইবোনের নিথর মরদেহের সঙ্গে আরও ২২ জনের মৃতদেহ সারিবদ্ধভাবে সাজানো। দুনিয়া থেকে সবচেয়ে প্রিয়জন এবং পরিবারের সকল সদস্যদের হারিয়ে একা বেঁচে থাকা মীম তখনও জানে না তার আর কেউ রইলো না পৃথিবীতে।
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার দোতরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে বসে কাঁদছিলেন (২৭) বছর বয়সী শহিদুল মোল্লা। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার কেউ ছিল না।
দুর্ঘটনায় তার ভাই শাহাদাত হোসেন মোল্লা (২৯) প্রাণ হারিয়েছেন। শাহাদাতের বাড়ি মাদারীপুরেরর শিবচর উপজেলার নিয়ামতকান্দী গ্রামে। মৃত আদম আলী মোল্লা ও রিজিয়া বেগম দম্পতির ছয় ছেলে চার মেয়ের মধ্যে ছোট শাহাদাত। তিনি এ বছর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করেছেন।
শাহাদাত হোসেন মোল্লার চাচাতো ভাই সাবেক মেম্বার দাদন মোল্লা (৬০) বলেন, এ বছর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করেছে শাহাদাত। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ঢাকা যায়। ইন্টারভিউ শেষে বাড়ি ফিরছিল। চাকরি করা হলো না শাহাদাতের। লাশ হয়ে তাকে ফিরতে হলো। আজো মনে পড়ে ওর স্মৃতি।
শহিদুল মোল্লা কান্না করতে করতে বলেন, ‘আদরের ছোট ভাই শাহাদাত। লগডাউনের ভেতর ঢাকা যেত না করেছিলাম। তবুও গেছে। তাই ভাইকে হারালাম।’
জেডআই/ডা