• ঢাকা রবিবার
    ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১

বীর যোদ্ধা মজনু এখন করাতকল শ্রমিক, থাকেন গুচ্ছগ্রামে!

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০২১, ০৮:৫৮ পিএম

বীর যোদ্ধা মজনু এখন করাতকল শ্রমিক, থাকেন গুচ্ছগ্রামে!

তোফায়েল হোসেন জাকির, গাইবান্ধা প্রতিনিধি

মজনু মিয়া। ’৭১-এ ছিলেন টগবগে যুবক। তখন জীবনের মায়া ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধার অংশগ্রহণে দেশ হয়েছিল স্বাধীন। জনগণ পেয়েছে স্বাধীনতার সুখ। কিন্তু দেশ স্বাধীনের ৫০ বছরেও মজনু মিয়া পাননি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। তাই জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি এখন করাতকল শ্রমিক। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দুর্বিষহ জীবনে বসবাস করছেন একটি গুচ্ছগ্রামে।

মজনু মিয়ার বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়নের জয়েনপুর গ্রামে। তিনি ওই গ্রামে মৃত খবির উদ্দিনের ছেলে। মজনু মিয়ার বয়স এখন প্রায় ৬৬ বছর। বসতভিটা হারিয়ে বর্তমানে তিনি জয়েনপুরের একটি গুচ্ছগ্রামে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

জানা যায়, সেই সময় দেশটা ছিল উত্তাল। বাংলাকে নিজের রূপে রূপ দেয়ার নেশায় কাঁপছিল পুরো দেশ। পাকিস্তানিদের শোষণ আর অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এদেশের জনগণ। ঠিক তখনই মজনু মিয়া জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশ রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধিকার আদায়ের জন্য। তার অদম্য সাহস আর দেশপ্রেম তাকে নিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধে।

তিনি ভারতের কাকড়ীপাড়া প্রশিক্ষণ শিবিরের আজিম মাহবুরের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে গাইবান্ধার কামারজানি, কঞ্চিবাড়ী ও দক্ষিণ দুর্গাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ক্যাপ্টেন হামিদ উল্লার নেতৃত্বে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

তার অধিনায়ক ছিলেন আব্দুল হামিদ পালোয়ান। যুদ্ধকালীন ১১নং সেক্টরে মজনু মিয়ার সহযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন- আবেদ আলী, সুলতান গিয়াস ও আলতাফ হোসেন। এই মহাবীরের এমন অনেক সফল সাহসী অভিযান হয়েছিল যুদ্ধকালীন সময়ে। দেশ হয়েছিল স্বাধীন।


তৎকালীন সময়ের অধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানী স্বাক্ষরিত দেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র পান মজনু মিয়া। যার সনদ নম্বর ১৬৫৮৮৫। কিন্তু মজনু মিয়া সনদ পেলেও পাননি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। যুদ্ধের পর বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গাইবান্ধা জেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার নাজমুল আরেফিন তারেক, সাদুল্লাপুর উপজেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার মেছের উদ্দিন সরকারসহ আরও অনেকে তাকে প্রত্যয়নপত্র দেন।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গেজেটধারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে দুই বছর আগে অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আবেদন করেন তিনি। এরই প্রেক্ষিতে সাদুল্লাপুর উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি কর্তৃক মজনু মিয়াকে ‘গ’ তালিকাভুক্ত করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মজনু মিয়ার সংগ্রামী সনদপত্র থাকলেও ক্রমিক নম্বর নেই। এ কারণে তাকে তালিকা থেকে বাতিল করা হয়েছে। অথচ ওই সনদপত্রের অপর পৃষ্ঠায় ক্রমিক নম্বর ছিল। বাধ্য হয়ে মজনু মিয়া জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আপিল করেন।

পরবর্তীতে গাইবান্ধা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. ইউনুস আলী সরকার সাদুল্লাপুর ইউএনওর নিকট ডিও লেটার দেন। তৎকালীন ইউএনও রহিমা খাতুন ওই ক্রমিক নম্বর যাচাইয়ের জন্য সাদুল্লাপুর উপজেলা সমাজসেবা অফিসারকে দায়িত্ব দেন। এর ফলে মজনু মিয়ার যুদ্ধকালীন যাবতীয় কাগজপত্র পুনঃযাচাই-বাছাই করে ক্রমিক নং খুঁজে পান এবং তার নাম তালিকাভুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠান।

এসব তথ্য নিশ্চিত করে মজনু মিয়া বলেন, “সাদুল্লাপুর উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি কর্তৃক আমাকে ‘গ’ তালিকাভুক্ত করায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আপিল করি। এরই প্রেক্ষিতে ফের যাচাই-বাছাই কার্যক্রমে চিঠির মাধ্যমে আমাকে ডাকা হয়। গত ৬ অক্টোবর ২০২১ তারিখে গাইবান্ধা সার্কিট হাউজ সম্মেলন কক্ষে এ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করি। এ সময় মুক্তিযোদ্ধার সপক্ষে আবেদনের কপি ও সকল প্রমাণ পেশ করা হয়।”

তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরও বলেন, “আমার কোনো অর্থসম্পদ কিংবা কোনো জমিজমাও নেই। প্রায় ১৩ বছর ধরে পরিবার নিয়ে গুচ্ছগ্রামে বসবাস করে আসছি। জীবিকার তাগিদে স্থানীয় একটি স’ মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করছি। সরকার আমাকে যদি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিত তাহলে শেষ বয়সে হয়তো কিছুটা শান্তি পেতাম।”

সাদুল্লাপুর উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবেদ আলী বলেন, ‘যুদ্ধকালীন সময়ে ১১নং সেক্টরে মজনু মিয়ার সহযোদ্ধা হিসেবে একই সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। তাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়ার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।’

এস/এম. জামান

দেশজুড়ে সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ